বাংলাদেশের হাওর: জীববৈচিত্র্যের এক অপূর্ব আধার
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক হল হাওর। এটি একটি অগভীর জলাভূমি বাস্তুতন্ত্র, যা গঠনগতভাবে বাটি বা গামলা আকৃতির। প্রচলিত অর্থে, নদীতীরে নির্মিত মাটির বাঁধের মধ্যে থাকা প্রায় গোলাকৃতি নিম্নভূমি বা জলাভূমিকে হাওর বলা হয়। তবে সব হাওরই বাঁধের মধ্যে থাকে না। বর্ষাকালে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে বছরের কয়েক মাস পানিতে ডুবে থাকে, এবং শুষ্ক মৌসুমে বিস্তীর্ণ শ্যামল প্রান্তরে পরিণত হয়।
- *হাওরের উৎপত্তি ও ভৌগোলিক অবস্থান:**
“সাগর” শব্দ থেকে “হাওর” শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানের ভিত্তিতে হাওরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এই তিন শ্রেণীর হাওরের মৎস্য সম্পদ, পানি সম্পদ, কৃষি এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা আলাদা আলাদা। IUCN-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে, সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি।
- *উল্লেখযোগ্য হাওর:**
- **হাকালুকি হাওর:** বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর (১৮,১১৫ হেক্টর)। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, কুলাউড়া, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ এবং জুরি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় ও পূর্বে ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। ২৭৩ টি ছোট, বড় ও মাঝারি বিল রয়েছে।
- **টাঙ্গুয়ার হাওর:** সুনামগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি (প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার)। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান। ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০ টিরও বেশি ঝর্ণা এসে মিশেছে এখানে।
- *হাওরের গুরুত্ব ও সংরক্ষণ:**
হাওর অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, পাখি, এবং অন্যান্য প্রাণী বাস করে। বর্ষা শেষে প্লাবিত হাওরের মাটি উর্বর হয়, যা কৃষিকাজের জন্য উপযোগী। অতিথি পাখিদের জন্য হাওর সাময়িক বিশ্রামক্ষেত্র। হাওরের বনাঞ্চলে হিজল ও কবোচের মতো জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ জন্মায়। তবে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, মাটি ভরাট, বসতবাড়ি নির্মাণ, বোরো চাষ, বন উজাড় প্রভৃতি কারণে হাওরের বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। হাওর সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা এবং কঠোর আইন প্রয়োজন।