বিদ্যুৎ: জীবনের অপরিহার্য শক্তি
বিদ্যুৎ, তড়িৎ আধানের স্থিতি বা গতির ফলে উৎপন্ন এক প্রকার শক্তি। এটি চুম্বকত্বের সাথে মিলিত হয়ে তড়িৎ-চুম্বকত্বের জন্ম দেয়, যা বজ্রপাত, তড়িৎ ক্ষেত্র, তড়িৎ প্রবাহ ইত্যাদি ঘটনার মূলে। মানুষের প্রাচীনকালের বিদ্যুৎ সম্পর্কিত জ্ঞান ছিল ইল মাছের শক সম্পর্কে। ১৬০০ সালে উইলিয়াম গিলবার্ট প্রথম তড়িৎ ও চুম্বকত্বের মিল সম্পর্কে আলোকপাত করেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন পরীক্ষার মাধ্যমে বজ্রপাতের সাথে বিদ্যুতের সম্পর্ক প্রমাণ করেন। পরবর্তীকালে মাইকেল ফ্যারাডে, জর্জ ওহম প্রমুখ বিজ্ঞানীর গবেষণায় বিদ্যুতের ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।
পদার্থের পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনের মৌলিক ধর্মই হলো তড়িৎ আধান। C.G.S. পদ্ধতিতে একক আধান হলো এমন দুটি সমপরিমাণ বিন্দু আধান যা এক সেমি দূরত্বে এক ডাইন বল প্রয়োগ করে। এর SI একক কুলম্ব (C) এবং CGS একক স্ট্যাটকুলম্ব (esu)। তড়িৎ বিভব হলো তড়িতাহিত বস্তুর এমন অবস্থা যা থেকে বোঝা যায় আধানের প্রবাহের দিক। অসীম দূরত্ব থেকে একক ধনাত্মক আধানকে তড়িৎক্ষেত্রের কোন বিন্দুতে আনতে যে কার্য করতে হয় তাকে তড়িৎ বিভব বলে। কোন ধাতব পরিবাহীর প্রস্থচ্ছেদ দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ আধানকে তড়িৎ প্রবাহ বলে, আর এর হারকে তড়িৎ প্রবাহ মাত্রা (CURRENT) বলে। এটি দুই প্রকার: সম প্রবাহ (DC) এবং পরিবর্তী প্রবাহ (AC)। তড়িৎ প্রবাহের আন্তর্জাতিক একক এম্পিয়ার (A)।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা একটি সমন্বিত নেটওয়ার্ক যা বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সাথে জড়িত। বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৫০ হার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতে এবং ১১/১৫ কিলোভোল্টে, যা ট্রান্সফরমার দিয়ে ১৩২/২৩০ কেভিতে উন্নীত করা হয়। গ্রিড সাব-স্টেশনে এটি ৩৩ কেভি, ১১ কেভি, এবং ০.৪ কেভিতে নামানো হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ গ্রিডে প্রায় ২,৩১৪ সার্কিট কিলোমিটার ২৩০ কেভি লাইন, ৫,৫৩৩ সার্কিট কিলোমিটার ১৩২ কেভি লাইন, এবং ১৬৭ সার্কিট কিলোমিটার ৬৬ কেভি লাইন ছিল। ৮৫টি গ্রিড সাব-স্টেশন বিদ্যুৎ বিতরণ করে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) প্রায় ৭৫% বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, বাকি ২৫% IPP ও RPP উৎপাদন করে। PGCB গ্রিড নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব বিউবো, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, ডিপিডিসি, ডেসকো, ও ওজোপডিকোর উপর ন্যস্ত। বাংলাদেশ পদ্মা ও যমুনা নদী দ্বারা দুটি অঞ্চলে বিভক্ত; পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুতের সিংহভাগ উৎপাদিত হয়। পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ ঘাটতি এলাকা, যা পূর্বাঞ্চল থেকে ২৩০ কেভি লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পায়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ধরন: স্টিম টারবাইন, গ্যাস টারবাইন, কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং বায়ু টারবাইন। স্টিম টারবাইন কেন্দ্রে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, বা ফার্নেস অয়েল ব্যবহার হয়। দেশের বৃহত্তম স্টিম টারবাইন কেন্দ্র ঘোড়াশালে। দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র বড়পুকুরিয়ায়। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র গোয়ালপাড়ায়। হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাস টারবাইন কেন্দ্র রয়েছে। মেঘনাঘাটে কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন কেন্দ্র। কাপ্তাইয়ে দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মাতামুহুরিতে দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা নগরীতে ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল বছরে ২২০ কিলোওয়াট। ৪৭% মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা পায়। বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। ২০১১ সালের জুনে মোট উৎপাদন ছিল ৪,৬০০ মেগাওয়াট। ২০১২ সালের মার্চে উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৮০০৫ মেগাওয়াটে পৌঁছায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট উৎপাদন ছিল ২৫,৬২২ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার। বিদ্যুতের বিতরণের দায়িত্ব ডিপিডিসি, ডেসকো, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের উপর ন্যস্ত। কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ।