বদরুদ্দোজা

দুই বদরুদ্দোজা: রাজনীতি ও চিকিৎসার অসাধারণ সমন্বয়

বাংলাদেশের ইতিহাসে দুইজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ‘বদরুদ্দোজা’ নামে পরিচিত। একজন ছিলেন কলকাতার মেয়র ও রাজনীতিবিদ সৈয়দ বদরুদ্দোজা এবং অপরজন বাংলাদেশের পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ.কিউ.এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। প্রথম বদরুদ্দোজার জীবন ছিল উপনিবেশিক ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অপরজনের জীবন ছিল চিকিৎসা, রাজনীতি এবং জনকল্যাণমূলক কাজের এক অনন্য সমন্বয়।

সৈয়দ বদরুদ্দোজা (১৮৯৮-১৯৭৪):

সৈয়দ বদরুদ্দোজা কলকাতার একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। খিলাফত আন্দোলন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদী কর্মী হিসেবে পরিচিত হন। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণে তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে কাজ করেন। কলকাতার মেয়র হিসেবে তিনি দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণ তহবিল গঠন করে জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ভারত বিভাগের তিনি তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং স্বাধীন ও অবিভক্ত বাংলার পক্ষে সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসু পরিকল্পনা সমর্থন করেন। ১৯৪৭ সালের পর তিনি বেশ কয়েকবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এবং ভারতীয় লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক মতবাদের জন্য তাকে কয়েকবার কারারুদ্ধও করা হয়।

এ.কিউ.এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী (১৯৩২-):

এ.কিউ.এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী একজন বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং জনকল্যাণকর্মী ছিলেন। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগরের মজিদপুর দয়হাটার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা, লন্ডন এবং ওয়েলসের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি রাজশাহী, স্যার সলিমুল্লাহ এবং সিলেট মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ন্যাশনাল অ্যান্টি-টিউবারকিউলোসিস অ্যাসোসিয়েশনের এবং আই.ইউ.এ.টি.এল.ডি-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতিতে যোগদান করে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হন। তিনি জিয়াউর রহমানের কেবিনেটে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার কেবিনেটে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা ও বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে কাজ করেন। ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, কিন্তু দলীয় বিরোধের কারণে ২০০২ সালে পদত্যাগ করেন। তিনি ‘বিকল্প ধারা’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ‘হেল্থ এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ নামে একটি জনকল্যাণমূলক ট্রাস্টের সাথে জড়িত আছেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও অংশগ্রহণ করেছেন। চিকিৎসা ও রাজনীতি ছাড়াও তিনি নাট্যকার, লেখক ও সুবক্তা হিসেবে সুপরিচিত এবং তিনি জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন।

মূল তথ্যাবলী:

  • সৈয়দ বদরুদ্দোজা: কলকাতার মেয়র, খিলাফত ও আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মী।
  • সৈয়দ বদরুদ্দোজা: হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সমর্থক, পরে মুসলিম জাতীয়তাবাদী।
  • এ.কিউ.এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী: বাংলাদেশের ১৫তম রাষ্ট্রপতি, বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ ও রাজনীতিবিদ।
  • এ.কিউ.এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য।
  • উভয় বদরুদ্দোজাই তাদের কর্মজীবনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।