তারাগঞ্জ: রংপুরের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির ধারক
বাংলাদেশের রংপুর জেলার অন্তর্গত তারাগঞ্জ উপজেলা, ঐতিহাসিক ঘটনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক অপরিসীম সমন্বয়। ১২৮.৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলাটি ২৫°৪৪´ থেকে ২৫°৫০´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৫৭´ থেকে ৮৯°০৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। উত্তরে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ, দক্ষিণে বদরগঞ্জ, পূর্বে গঙ্গাচড়া ও রংপুর সদর, এবং পশ্চিমে সৈয়দপুর উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত।
- *ঐতিহাসিক গুরুত্ব:**
তারাগঞ্জের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। জনশ্রুতি আছে যে, বহু আগে ‘তারা বিবি’ নামে একজন পূণ্যবতী নারী এখানে বাস করতেন। তারাগঞ্জ হাটের কাছে তার মাজার এখনো বিদ্যমান, যার নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ হয়েছে। ১৭৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় সয়ার ইউনিয়নের শ্যামগঞ্জে ইংরেজ বাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই হয়, যেখানে ইংরেজরা পরাজিত ও সেনাপতি টমাস নিহত হন। ১৭৮৩ সালের ‘রংপুর বিদ্রোহ’, ১৮৫৯ সালের নীল বিদ্রোহ, ১৯৩৭-৪০ সালের হাটতোলা আন্দোলন এবং ১৯৪৬-৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলনে তারাগঞ্জের জনগণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধকালে সরাসরি যুদ্ধ না হলেও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর যমুনেশ্বরী নদীর বরাতি সেতুতে গণহত্যা সংঘটিত হয়।
- *ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:**
তারাগঞ্জের প্রধান নদী হলো যমুনেশ্বরী, চিকলী। এখানে হাতখোপা বিলও রয়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা ১৪২,৫১২; পুরুষ ৭১,৮৯৮ এবং মহিলা ৭০,৬১৪। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলিম (১২৪,৫৭৮), হিন্দু (১৭,৮৮৩), খ্রিষ্টান (১৩) এবং অন্যান্য (৩৮)।
- *অর্থনীতি:**
কৃষি তারাগঞ্জের অর্থনীতির মূল ভিত্তি (৮০.৩৮%)। ধান, পাট, আলু, আদা, তামাক, রসুন, পিঁয়াজ, গম, হলুদ প্রধান কৃষি ফসল। আম, কাঁঠাল, জাম, কলা, জামরুল, লিচু, পেঁপে প্রধান ফল। মৎস্য, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খামারও রয়েছে। অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যবসা, পরিবহণ, চাকরি, নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। আদা, তামাক, ধান, চাল, পাট প্রধান রপ্তানিদ্রব্য।
- *শিক্ষা ও সংস্কৃতি:**
শিক্ষার হার ৪৩.৮%। কলেজ, কারিগরি কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লাইব্রেরী, ক্লাব, সিনেমা হল, থিয়েটার গ্রুপ, অডিটোরিয়াম ও খেলার মাঠ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য।
- *প্রশাসন:**
তারাগঞ্জ ১৯৮০ সালের পূর্বে বদরগঞ্জ থানার অধীনে ছিল। ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি ৪০টি গ্রাম নিয়ে তারাগঞ্জ থানা গঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। তারাগঞ্জ ৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত:
- আলমপুর ইউনিয়ন
- কুর্শা ইউনিয়ন
- একরচালী ইউনিয়ন
- হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়ন
- সয়ার ইউনিয়ন
তারাগঞ্জের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে এবং এই উপজেলা রংপুর জেলার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।