মুক্তিযুদ্ধের অমর নায়ক জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণী ওসমানী
জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণী ওসমানী (১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮ – ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪) বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমর নায়ক, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং প্রথম সেনাপ্রধান। তার জীবন ছিল দেশপ্রেম, সাহস, এবং অদম্যতায় পরিপূর্ণ। সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা ওসমানীর পৈত্রিক নিবাস ছিল সিলেটের দয়ামীরে।
শিক্ষাজীবন ও প্রাথমিক কর্মজীবন:
ওসমানী ছাত্রজীবনেই তার উজ্জ্বল প্রতিভা প্রদর্শন করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রিটোরিয়া পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৩৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তিনি সামরিক পেশা বেছে নেন।
ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী:
ওসমানী ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন এবং ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দীর্ঘসময় কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালে কর্নেল পদে অবসর গ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক জীবন ও মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠন ও পরিচালনায় অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চার তারকা জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীতে জেনারেল পদ বিলুপ্ত হওয়ার পর অবসর গ্রহণ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের কর্মজীবন ও পরবর্তীকাল:
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একদলীয় ব্যবস্থার বিরোধিতায় ১৯৭৪ সালে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় জনতা পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৮৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন এবং সিলেটে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত হন।
সম্মান ও স্মৃতি:
ওসমানীর অবদানকে স্মরণ করে সিলেটে তার নামে মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঢাকায় ওসমানী উদ্যান ও ওসমানী মেমোরিয়াল হল রয়েছে।
জেনারেল ওসমানী একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি তার দেশপ্রেম, সাহসিকতা, এবং দূরদর্শিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।