বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা ছাগলনাইয়া। ইংরেজ শাসনামলে দাপ্তরিক নথিতে ‘R’ এর স্থলে ভুলবশত ‘L’ লেখার ফলে ‘সাগরনাইয়া’ নামটি ‘ছাগলনাইয়া’ হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। উপজেলার অবস্থান ২৩°০২′১০″ উত্তর ৯১°৩১′১০″ পূর্ব। এটি উত্তরে ফুলগাজী, দক্ষিণে ফেনী সদর ও চট্টগ্রামের মীরসরাই, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা এবং পশ্চিমে পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলার সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত।
ঐতিহাসিকভাবে ছাগলনাইয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে। কিছু মত অনুযায়ী, এটি একসময় বৌদ্ধ সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। পরে নদী ভাঙ্গনে সাগরে বিলীন হয়ে আবার ধীরে ধীরে ভূমি জেগে উঠে। কয়েকশ বছর আগেও পুরান রাণীর ঘাট থেকে পশ্চিম ছাগলনাইয়া পর্যন্ত প্রশস্ত নদী ছিল, যার পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ছিল খেয়া নৌকা।
ব্রিটিশ আমলে ছাগলনাইয়ার নামকরণ হয়। বগুড়ার রামচন্দ্র চৌধুরী নবাব সরকারের কাজের জন্য একাদশ শতাব্দীতে ভুলুয়ায় (বর্তমান নোয়াখালী) এসে বসতি স্থাপন করেন। পরে ত্রিপুরা মহারাজের কর্মচারী হন। মহারাজের নির্দেশে তিনি খন্ডল (বর্তমান ছাগলনাইয়া) এলাকার বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেন এবং ত্রিপুরা মহারাজ তাকে খন্ডলের ইজারাদার নিযুক্ত করেন। শমসের গাজীর আবির্ভাবে জমিদারদের ক্ষমতা হ্রাস পায়। কখন থেকে এখানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে তার সঠিক তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ১৭১২-১৩ সালের চাঁদগাজী মসজিদ এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য।
খন্ডলের ভূমি ভাঙ্গা-গড়ার সাথে জনমানুষের উত্থান-পতন ঘটেছে। শিলুয়ার শিল বৌদ্ধ ধর্মের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, একটিমাত্র নিদর্শন দিয়ে এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করা বিপজ্জনক বলে গবেষকরা মনে করেন। মিরসরাইয়ের ভগবতীপুর গ্রামে ৭০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১১০০-১২০০ সালের দিকে বৌদ্ধ রাজারা দুর্বল হয়ে পড়লে হিন্দু এবং পরে মুসলমানরা এখানে আধিপত্য বিস্তার করে। ১৯৬৩ সালে পুকুর খননের সময় নব্য প্রস্তর যুগের হাতকুড়াল পাওয়া গেছে যা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
বর্তমানে ছাগলনাইয়া উপজেলায় ১টি পৌরসভা এবং ৫টি ইউনিয়ন আছে। জনসংখ্যা প্রায় ১,৭০,৫২৪; পুরুষ ৮৫,২৮৪, মহিলা ৮৫,২৪০। মুসলিম ১,৬৫,৪৬৩, হিন্দু ৪,৯৯৫, খ্রিস্টান ২১ এবং অন্যান্য ৪৫। শিক্ষার হার ৬৩.১%। কলেজ ৬টি, উচ্চ বিদ্যালয় ২৭টি, প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭০টি, মাদ্রাসা ২৯টি। মসজিদ ২৭৫টি, মন্দির ১০টি, মাজার ২টি। চাঁদগাজী ভূঞা মসজিদ, দক্ষিণ বল্লভপুর মসজিদ, নিজপানুয়া পীরের মাজার, রৌশন ফকিরের মাজার ও জগন্নাথ মন্দির উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। পাকা রাস্তা ৯৫ কিমি, মাটির রাস্তা ৪১২ কিমি। কৃষিজীবী ৩৮.১৪%, প্রবাসী ৭.১৯%, শিল্প ১.৫৫% এবং চাকুরিজীবী ১৭.৮৬%। হাটবাজার ২৮টি এবং মেলা ৩টি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বাজারও রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালে ছাগলনাইয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে শুভপুর ব্রিজে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ, মে মাসে কালাপুরের কালাব্রিজে পাকসেনা ঘাঁটিতে আক্রমণ, ২৯ মে গোপাল ইউনিয়নে সম্মুখসমর, জুলাইতে মধুগ্রামে লড়াই এবং নভেম্বরে শুভপুরে সম্মুখসমর উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ‘অপারেশন ছাগলনাইয়া’ মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে, যার সাথে জিয়াউর রহমান ও লে. জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের সংযোগ ছিল। রেজুমিয়া সেতুর নিচে একটি বধ্যভূমি ছিল। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছাগলনাইয়া হানাদারমুক্ত হয়।