গৃহবন্দি: আইনানুগ ও অবৈধ দুই রূপ
ন্যায়বিচারের আশ্রয় নিয়ে বা অপরাধের শাস্তি হিসেবে গৃহবন্দি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের নিজ বাসভবনে আবদ্ধ থাকে। এটি গৃহ কারাবাস, গৃহ আটক, অথবা আধুনিক যুগে ইলেকট্রনিক পর্যবেক্ষণ নামেও পরিচিত। সাধারণত যাতায়াত নিষিদ্ধ, তবে ব্যতিক্রমী কারণে আংশিক অনুমতি থাকতে পারে। বিচারের অপেক্ষায় থাকা অথবা সাজা ভোগের সময় কারাগারের বিকল্প হিসেবে গৃহবন্দি ব্যবহৃত হয়।
কারাগারে যথাযথ ব্যবস্থার অভাব থাকলে ফৌজদারি মামলায় গৃহবন্দি প্রযোজ্য হতে পারে। অন্যদিকে, স্বৈরাচারী সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে গৃহবন্দির ব্যবহার করে থাকে। এই অবস্থায় গৃহবন্দি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বাহিরের জগতের সাথে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা থাকে; বৈদ্যুতিক যোগাযোগে পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা থাকে।
১৭শ শতাব্দীর আগে থেকেই বিচারকরা কারাগারের বিকল্প হিসেবে গৃহবন্দির রায় দিয়েছেন। গ্যালিলিও গ্যালিলি ১৬৩৩ সালে তার বিখ্যাত বিচারের পর গৃহবন্দি ছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের দমনে গৃহবন্দি প্রয়োগ করা হলেও, সাধারণ অপরাধীদের ক্ষেত্রে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়নি।
২০শ শতাব্দীর শেষভাগে নতুন ইলেকট্রনিক পর্যবেক্ষণ ডিভাইসের উদ্ভাবনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলিতে কারাগারের বিকল্প হিসেবে গৃহবন্দি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৩ সালে বোস্টনে বৈদ্যুতিক ব্রেসলেট ব্যবহার করে প্রথম আদালত গৃহবন্দির সাজা দেওয়া হয়।
গৃহবন্দির লক্ষ্য হলো পুনরায় অপরাধের হার কমানো এবং বন্দি সংখ্যা কমিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ সাশ্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক সাজার আইনের কারণে কারাদণ্ডের হার বৃদ্ধি পেলে গৃহবন্দি একটি সংশোধনকারী ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটি যোগ্য অপরাধীদের কর্মসংস্থান, পারিবারিক জীবন ও পুনর্বাসন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়।
গৃহবন্দির শর্ত ভিন্ন হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্মরত অপরাধীরা কাজ চালিয়ে যেতে পারে, কেবল কাজের বাইরের সময় গৃহে থাকতে হয়। প্রবেশন অফিসারের সাথে দেখা, ধর্মীয় সেবা, শিক্ষা, আইনজীবীর সাথে দেখা, আদালতে উপস্থিতি, চিকিৎসা সেবা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে গৃহ ত্যাগের অনুমতি থাকতে পারে। ঘরে থাকার বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করতে পারে।
আদালতের আদেশ অনুযায়ী গৃহবন্দির তীব্রতা পরিবর্তিত হতে পারে। সান্ধ্য আইন নির্দিষ্ট সময়ে গৃহে থাকার নির্দেশ দেয়। পূর্ণ গৃহবন্দিতে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র বাদে সর্বদা গৃহে থাকতে হয়। সবচেয়ে কঠোর গৃহবন্দি হল গৃহ কারাদণ্ড, যেখানে আদালত অনুমোদিত ব্যতিক্রম ছাড়া ২৪ ঘণ্টা গৃহে থাকতে হয়।
কিছু ক্ষেত্রে বিচার বা আইনি প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গৃহবন্দি করা হয়, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়। স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নমত দমনে এই পন্থা ব্যবহার করা হতে পারে।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে গৃহবন্দির নজরদারি করা হয়। গোড়ালির চারপাশে ইলেকট্রনিক সংবেদক লাগিয়ে অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রয়োজন হলে স্বয়ংক্রিয় কল সেবা ব্যবহার করা হয়।
গৃহবন্দি কারাগারের তুলনায় অর্থনৈতিক ভাবে সুলভ হলেও, অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয়। এছাড়া গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কমে যাওয়ার সমালোচনা থাকে। পাকিস্তানের ইমরান খান এবং মালয়েশিয়ার নাজিব রাজাকের ক্ষেত্রে গৃহবন্দির উদাহরণ দেওয়া যায়।