গাইবান্ধার ফুলছড়ি: মুক্তিযুদ্ধের এক অমর অধ্যায়
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধার ফুলছড়ি এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম লেখে। ৪ ডিসেম্বর, এই দিনটি ফুলছড়ির ইতিহাসে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের দিন হিসেবে চিহ্নিত। পাঁচ বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই দিনে ফুলছড়ি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়।
যুদ্ধের পটভূমি:
১৯৭১ সালের ২৩শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তৎকালীন ফুলছড়ি সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ কার্যালয়) থেকে চার কিলোমিটার দূরে তিস্তামুখ রেলওয়ে ফেরিঘাট এলাকায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। এই ক্যাম্প থেকে তারা আশপাশের গ্রামগুলিতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ন্যক্কারজনক অপরাধ চালিয়ে যায়। এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার ছাত্র-যুবকরা জুন মাসের প্রথম দিকে সীমান্ত এলাকা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসে। ১১ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে তারা ফুলছড়ির গলনারচরে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।
৪ ডিসেম্বরের যুদ্ধ:
৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গৌতম চন্দ্র মোদকের নেতৃত্বে সামছুল আলম, নাজিম উদ্দিন, আব্দুল জলিল তোতা, এনামুল হকসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা ফুলছড়ি থানার আশপাশে অবস্থান নেয়। পরদিন ৪ ডিসেম্বর ভোরে গেরিলা কমান্ডার সামছুল আলমের দল ফুলছড়ি থানা আক্রমণ করে। এরপর অন্যান্য দলের মুক্তিযোদ্ধারাও চারিদিক থেকে আক্রমণ করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা থানার অস্ত্রাগারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। ওই দিনই ফুলছড়ি উপজেলা ও তিস্তামুখ রেলওয়ে ফেরিঘাট পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা:
এই যুদ্ধে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: আফজাল হোসেন, কবেজ আলী, যাহেদুর রহমান বাদল, ওসমান গণী এবং আব্দুস সোবহান। ৫ ডিসেম্বর তাদের মরদেহ গরুর গাড়িতে করে সাঘাটা থানার সগুনা ইউনিয়নের খামার ধনারুহা স্কুলের দক্ষিণ-পশ্চিমে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তাদের সম্মানে সগুনা ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করে মুক্তিনগর ইউনিয়ন রাখা হয়। এছাড়াও, শহীদদের কবরের পাশে একটি স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে।
ফুলছড়ি মুক্ত দিবস:
প্রতিবছর ৪ ডিসেম্বর ফুলছড়ি উপজেলা মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
উপসংহার:
গাইবান্ধার ফুলছড়ির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমর অধ্যায়। পাঁচ বীর মুক্তিযোদ্ধার বলিদানের ফলে অর্জিত এই মুক্তি সর্বদাই আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।