সম্পত্তি

সম্পত্তি: অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ‘সম্পত্তি’ শব্দটি জটিল রাজনৈতিক ও আইনগত জটিলতার সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে শুরু হওয়া ‘শত্রু সম্পত্তি’র ধারণা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ‘অর্পিত সম্পত্তি’ ও ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’র রূপ নেয় এবং বহু বছর ধরে জটিল আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এই লেখায় আমরা সম্পত্তি, বিশেষ করে অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, ঘটনা, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

  • *অর্পিত সম্পত্তি:** ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের সম্পত্তিকে পাকিস্তান সরকার ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সালে, এগুলোর নামকরণ করা হয় ‘অর্পিত সম্পত্তি’। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর এবং ১৯৬৬ সালের ৮ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেন। ১৯৬৯ সালে ‘শত্রু সম্পত্তি (জরুরি বিধানসমূহের ধারাবাহিকতা) অধ্যাদেশ’ জারি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৯ নং রাষ্ট্রপতি আদেশ অনুসারে, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অর্পিত সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে চলে আসে। ১৯৭৪ সালের ৪৫ নং আইন পাসের মাধ্যমে শত্রু সম্পত্তি আইন প্রণীত হয়। ১৯৭৭ সালের ২৩ মে ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় অর্পিত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশাবলী জারি করে। ১৯৮২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আইন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। ১৯৮৩ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সকল অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তর ও বিলিবন্টন করতে হবে। ১৯৮৪ সালের ৩১ জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মহাসম্মেলনে অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। এরপর ১৯৮৪ সালের ২৩ নভেম্বর ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তরের সকল কার্যক্রম স্থগিত করে।
  • *পরিত্যক্ত সম্পত্তি:** মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক সম্পত্তি পরিত্যক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তি) আদেশ জারি করেন এবং ৮ মে বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (জমি, ভবন ও অন্যান্য সম্পত্তি) বিধি জারি করেন। এই আদেশে পরিত্যক্ত সম্পত্তির সংজ্ঞা, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়। ১৯৮২ সালে ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার বিভাগ পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিষ্পত্তির নীতিমালা জারি করে।
  • *সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল:** রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। ১৮৯৪ সালের ‘দি ল্যান্ড একুইজিশন অ্যাক্ট’ প্রথম আইন হিসেবে উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার পর, বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখলের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৮২ সালের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশে সম্পত্তির সংজ্ঞা দেওয়া হয়। হুকুমদখলের পদ্ধতি, ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ, আপিল প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আইনে বর্ণিত। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরের জমি অধিগ্রহণের জন্য আইন জারি করা হয়।
  • *সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২:** এই আইন জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিক্রয়, বন্ধক, দান, বিনিময় ও ইজারা-সহ বিভিন্ন ধরনের হস্তান্তরের বিধান এ আইনে উল্লেখ আছে।

এই লেখাটি অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিল আইনি প্রক্রিয়ার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ মাত্র। আরও বিস্তারিত জানার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন ও নথিপত্র পর্যালোচনা করা উচিত।

মূল তথ্যাবলী:

  • ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত সম্পত্তি পরবর্তীতে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত হয়।
  • ১৯৭৪ সালে অর্পিত সম্পত্তি আইন পাস হয়।
  • ১৯৭২ সালে পরিত্যক্ত সম্পত্তি (নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তি) আদেশ জারি হয়।
  • রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণের জন্য ১৮৯৪ সালের ল্যান্ড একুইজিশন অ্যাক্ট প্রণীত হয়।
  • ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।