শীতলক্ষ্যা খেয়া ঘাট, গাজীপুর: একটি নদীর ওপর জীবনের ছবি
গাজীপুরের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত একটি খেয়া ঘাটের চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো। এই ঘাট শুধুমাত্র একটি পারাপারের মাধ্যম নয়, বরং শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুক্রবারের ছুটির দিনে ঘাটে যাত্রীদের ভিড় দেখে বোঝা যায় নদী পারাপারের গুরুত্ব। নৌকার যাত্রীদের মধ্যে নারী, পুরুষ ও শিশু সকলেই রয়েছে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কারও বাবার বাড়ি, কারও শ্বশুর বাড়ি, আবার কেউ যাচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।
শীতলক্ষ্যা নদীর কালো, দুর্গন্ধযুক্ত পানি স্পষ্টতই এই পারাপারের একটা অন্তরায়। একজন নারী তার সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই দুর্গন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বাচ্চার নাকে মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। অন্য একজন যাত্রী জানিয়েছেন, বাধ্য হয়েই তাঁদের এই ঘাট ব্যবহার করতে হয়।
খেয়াঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালের দিকে যাওয়ার পথে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত লঞ্চঘাটের ইতিহাসের স্মৃতি দেখা যায়। লঞ্চ থেকে নামা একজন পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধ, আব্দুল মজিদ, তার অতীতের স্মৃতি তুলে ধরেন, যেখানে তিনি শীতলক্ষ্যা নদীতে গোসল করতেন। কিন্তু আজ নদীর পানি দুর্গন্ধময় এবং দূষিত।
ঢাকার নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জ শহরের মধ্য দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর প্রবাহ বহুদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রহ্মপুত্র নদের শাখানদী হিসেবে সারা বছর নৌ চলাচলে উপযোগী থাকলেও, শিল্প বর্জ্যের কারণে এটি পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্বারা ‘মৃত নদী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নদী তীরের মানুষ ও কারখানার বর্জ্যের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে এই দূষণে।
শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে হাঁটার সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য এবং বাড়িঘর থেকে নির্গত ময়লা পানি নদীতে মিশে যাওয়া দেখা যায়। এই দূষিত পানিতেই লোকজন গোসল ও কাপড় ধোয়ার কাজ করে। একজন নারী জানান, সময়ের অভাবে তাঁদের এমন পানি ব্যবহার করতে হয়। নদীতে গোসল করা মোহাম্মদ হোসেনও জানান তিনি এই দূষিত পানিতে গোসল করেন এবং এতে অসুস্থতা হয়নি।
স্থানীয়দের বর্ণনা অনুসারে, একসময় শীতলক্ষ্যা নদী ছিল স্বচ্ছ ও শীতল পানির জন্য বিখ্যাত। কিন্তু আজ নদীর পানি বিষাক্ত। নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মুজাহেদুল ইসলাম জানান, নদীর পানিতে অক্সিজেনের অভাব জলজ প্রাণীর জন্য এটি অনুপযোগী করে তুলেছে। পানি দূষণের ফলে মাছের অস্তিত্বও সংকটাপন্ন।
৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খেয়া পারাপারের কাজে লিপ্ত নুরু মিয়া জানান, একসময় নদীর পানি পানযোগ্য ছিল, কিন্তু আজ তার গন্ধ অসহ্য। মাছ ধরার জেলেদের জীবন এই দূষিত নদী ঘিরে চলেছে। বন্দর উপজেলার একরামপুর জেলেপাড়ার শ্রীনিবাস, ৪০ বছরের জেলে, জানান, অনেক প্রজাতির মাছ নদী থেকে হারিয়ে গেছে। মাছ না পাওয়ার কারণে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২২০০ এর বেশি শিল্প কারখানা থাকলেও, মাত্র ২১৮টি প্রতিষ্ঠান ইটিপি (তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার) ব্যবহার করে। অনেক কারখানা ইটিপি ব্যবহার না করার অভিযোগ ও রয়েছে। মোহাম্মদ মুজাহেদুল ইসলাম উল্লেখ করেন, জরিমানা কোনও সমাধান নয়, এজন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
শীতলক্ষ্যার দূষণ নদী তীরবাসীর জীবনে প্রভাব ফেলেছে, তা নদী তীরে ফ্ল্যাট কিনে নির্মল পরিবেশের আশায় বসবাসকারী সুবাস সাহা ও মানসী চৌধুরীর অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট। তারা দুর্গন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন। শীতলক্ষ্যা নদীর দূষিত পানি থেকে ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকায় পানি সরবরাহ করা হলেও তা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে। দূষণ বন্ধের জন্য কারখানা বন্ধ করে দেয়া কিংবা গ্রেপ্তারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বাজার ঘেষা নদীর পাড়ে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে দূষণ বেড়েছে। স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করলেও, প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কসাইখানার বর্জ্য, পশুর উচ্ছিষ্ট, ময়লা, আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এমনকি একটা ভ্যান বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য এনে নদীর পাড়ে ফেলে যায়। বাজারের দুর্গন্ধে প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে এবং রোগের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজার ব্যবসায়ীরা ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গার অভাবে নদীতে ময়লা ফেলার কথা বলেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ময়লা নদীতে ফেলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।