বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, বা আরএমজি (Readymade Garments) শিল্প, দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ষাটের দশকে যাত্রা শুরু হলেও, সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে এটি রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে বিকাশ লাভ করে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮১.৮১%। বিশ্বে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় (চীনের পর)।
১৯৫০-এর দশকে পশ্চিমা দেশগুলোতে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৯৭৪ সালে মাল্টি ফাইবার এগ্রিমেন্ট (এমএফএ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পোশাক রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশ আরএমজি খাতে বৈদেশিক সাহায্য পেতে শুরু করে এবং কিছু বাংলাদেশি কর্মী কোরিয়ান কোম্পানি থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করে। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ইউরোপ ও আমেরিকাতে রপ্তানি হতে শুরু করে। নুরুল কাদের খান এবং দেশ গার্মেন্টসের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল।
প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দর্জিরা পোশাক তৈরি করতো। সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে এর উন্নয়ন ঘটতে থাকে। অভ্যন্তরীণ বাজারও সম্প্রসারিত হয় এবং এই খাতের সাথে জড়িতদের আয় ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। এটি কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য ছিল রপ্তানি আয়ের শীর্ষস্থানে। আশির দশকের শেষভাগে তৈরি পোশাক এই স্থান দখল করে নেয়। ১৯৯৯ সালে এই শিল্পে ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি লোক কর্মসংস্থান পেয়েছিল, যাদের ৮০% ছিল নারী। বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ ঘটে। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের (ওভেন শার্ট) প্রথম চালান রপ্তানি হয় ১৯৭৮ সালে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি ওভেন পোশাককে ছাড়িয়ে যায়। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাল্যবিবাহ কমেছে এবং সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্যোক্তা বৃদ্ধিও হয়েছে।
শুরুতে শিল্পটি সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্থানীয় উদ্যোক্তারা পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে স্থানীয়ভাবে সুতা ও কাপড় উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে অনেক বৃহৎ পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের বিকাশ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
১৯৭৮ সালে মাত্র ৯টি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ছিল। রিয়াজ গার্মেন্টস, প্যারিস গার্মেন্টস, জুয়েল গার্মেন্টস, এবং বৈশাখী গার্মেন্টস উল্লেখযোগ্য। রিয়াজ গার্মেন্টস ১৯৬০ সালে স্থানীয় বাজারে কাজ শুরু করে এবং ১৯৭৮ সালে প্রথম পোশাক রপ্তানি করে। ১৯৭৯ সালে দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড প্রথম যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কম উৎপাদন খরচের কারণে বাংলাদেশ বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয়। ব্যাক-টু-ব্যাক এল.সি লেনদেন পদ্ধতি চলতি মূলধনের সমস্যা লাঘব করে। ১৯৮২ সালে ৪৭টি কারখানা থেকে ১৯৯৯ সালে ২৯০০টি কারখানা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে কারখানার সংখ্যা ৩ হাজারে পৌঁছে।
বিশ্বের আর্থিক মন্দার প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ পোশাক শিল্প তার অবস্থান ধরে রেখেছে। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ শক্তিশালী পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইউএসএ, কানাডা ও ইউরোপের বাজার নিশ্চিত হয়েছে। সরকারের নীতি ও উদ্যোগগুলো এই শিল্পের সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তৈরি পোশাক শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় কারণই দায়ী। এমএফএ-এর কোটা পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল। শ্রমিকদের দক্ষতার উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাজার বহুমুখীকরণ এই শিল্পের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও শিশুশ্রম বন্ধ, ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের পরিবেশ উন্নয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয়তা ইত্যাদি বিষয়গুলোও উল্লেখযোগ্য। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ শিল্পের প্রধান সংগঠন। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা, বাজার বহুমুখীকরণ, এবং পণ্যের মান উন্নয়ন এই শিল্পের টেকসই বিকাশের জন্য অপরিহার্য। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করে পরবর্তীতে এই নিবন্ধটি আরও সমৃদ্ধ করব।