মাদারীপুরের রাজৈর: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার জেলা
বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলা অতীতের স্মৃতি ও বর্তমানের উন্নয়নের এক অপূর্ব সমন্বয়। ২২৯.২৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলাটির অবস্থান ২৩°০৬´ থেকে ২৩°২০´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৫৬´ থেকে ৯০°০৬´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। উত্তরে ভাঙ্গা উপজেলা, দক্ষিণে কোটালিপাড়া ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা, পূর্বে মাদারীপুর সদর ও শিবচর উপজেলা, এবং পশ্চিমে মুকসুদপুর ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা রাজৈরের সীমান্তবর্তী।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, রাজৈরের জনসংখ্যা প্রায় ২২৮,৭১০; পুরুষ ১১৩,০৩১ এবং মহিলা ১১৫,৬৭৯। ধর্মীয়ভাবে, এখানে ১৫৫,৪৪২ মুসলিম, ৭২,৫০৯ হিন্দু, ৮ বৌদ্ধ, ৭৪৫ খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ৬ জন বাস করেন। কুমার নদী রাজৈরের প্রধান নদী, যার পাশাপাশি মাদারীপুর বিলরুট ক্যানাল, চান্দার বিল ও বাগিয়ার বিলও উল্লেখযোগ্য।
১৯৮২ সালে রাজৈর থানা গঠিত হয় এবং ১৫ ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়। রাজৈরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। সেনদিয়া গ্রামের অম্বিকাচরণ মজুমদার ১৮৮১ সালে ‘ফরিদপুর পিপলস এসোসিয়েশন’ নামে পূর্ববঙ্গের প্রথম রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯১৮ সালে তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রাজৈর বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করে। পাকবাহিনীর নৃশংসতায় সেনদিয়া গ্রামের ৫০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন এবং বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। হাজীখাল, বড়ব্রিজ, টেকেরহাট, রাজৈর থানা, পাখুল্ল্যা, আমগ্রাম, বৈলগ্রাম প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়।
রাজৈরের অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। কৃষিজমির মালিকানা ভূমিমালিক ৬৯.০১% এবং ভূমিহীন ৩০.৯৯%। ধান, পাট, আখ, গম, মিষ্টি আলু, ডাল, সরিষা, তিল প্রভৃতি প্রধান কৃষি ফসল। এছাড়াও আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, লিচু, কলা, পেঁপে, সবেদা প্রভৃতি ফল উৎপাদিত হয়। পাট, খেজুর গুড়, তিল এবং সরিষার তেল রাজৈরের প্রধান রপ্তানিদ্রব্য।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যঃ রাজৈরের গড় শিক্ষার হার ৪৮.২%; পুরুষ ৫০.৯% এবং মহিলা ৪৫.৬%। কলেজ ৬ টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৯ টি, প্রাথমিক বিদ্যালয় ১২৮ টি, মাদ্রাসা ১৩ টি। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে রয়েছে হাসপাতাল ১ টি, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৬ টি, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ১০ টি এবং ক্লিনিক ৩ টি।
সংস্কৃতি ও পর্যটন: রাজৈরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। সরমঙ্গল মসজিদ, অন্নপূর্ণা মন্দির (১৭৬৫), খালিয়া রাজারাম মন্দির (১৮২৫) প্রভৃতি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। টেকেরহাট বন্দর, খালিয়া গণউন্নয়ন প্রচেষ্টার শান্তিকেন্দ্র, বাজিতপুর প্রণব মঠ, কমলাপুর নরোত্তমের আশ্রম প্রভৃতি পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয়।
উপসংহার: রাজৈর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য পরিচিত। এই উপজেলাটির উন্নয়নের জন্য আরও পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন রয়েছে যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করবে।