মাওলানা হাবিবুর রহমান: একজন সমাজ সংস্কারক ও ইসলামি পণ্ডিত
মাওলানা হাবিবুর রহমান (১৯৪৯-২০১৮) ছিলেন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সংগঠক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর এবং জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। তার জীবনকাল ছিল ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা: ১৯৪৯ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নের ঘনশ্যাম গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে হাবিবুর রহমানের জন্ম। তার পিতা মাহমুদ আলী ছিলেন সিলেটের হাওয়াপাড়া জামে মসজিদের ইমাম, খতীব এবং জমিয়ত উলামা-য়ে-হিন্দের নেতা। মাতা আছিয়া খাতুন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন ফুলবাড়ী ইউনিয়নের বইটিকর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর রুস্তমপুর কওমি মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়াশোনার পর ফুলবাড়ী আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৭০ সালে ফাযিল পাশ করেন। ১৯৭৩ সালে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন।
কর্মজীবন ও রাজনৈতিক অবদান: ১৯৭৩ সালে কাজির বাজার পেয়াজ হাটা মসজিদের ইমাম ও খতীব হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা। ১৯৭৪ সালের ৫ জুন আব্দুল করিমের পরামর্শে জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং আমৃত্যু এর অধ্যক্ষ ছিলেন। জমিয়তে উলামা-য়ে-ইসলাম বাংলাদেশে যোগদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সিলেট জেলা জমিয়তের মহাসচিব ছিলেন। মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জীর খেলাফত আন্দোলনে যোগদান, ১৯৮২ সালে হাফেজ্জীর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রচারণায় অংশগ্রহণ। ১৯৯৪ সালে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন এবং 'সাহাবা সৈনিক পরিষদ' গঠন করেন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে যোগদান এবং আজিজুল হকের সাথে কাজ। ২০১২ সালে আজিজুল হকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর হন। কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন। আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলীকে সভাপতি ও নিজে সাধারণ সম্পাদক হয়ে ইসলামি ঐক্য পরিষদ গঠন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার: আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেও সারাজীবন দেওবন্দি মতাদর্শের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ইসলামি সমাজ বিনির্মাণে অবদান, বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা। ২০১৬ সালে ‘এ্যানুয়াল কমিউনিটি লিডারশিপ’ পুরস্কার লাভ।
মৃত্যু: ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর বার্ধক্যজনিত রোগে সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জানাজা। কাজির বাজার মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন।
উল্লেখযোগ্য বিষয়: ২০ টি বই রচনা করেছেন। শায়খে কৌড়িয়া খ্যাত আব্দুল করিমের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল। হুসাইন আহমদ মাদানির শিষ্য আব্দুল জলীল বদরপুরীর খেলাফত পেয়েছিলেন। চার ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। তার জীবদ্দশায় শাহ মমশাদ আহমদ কর্তৃক “দীপ্ত জীবন” নামে তার একটি জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান রাহ. প্রজন্ম’ নামে একটি সংগঠন তার স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয়।