বরগুনার পাথরঘাটা: উপকূলের গৌরবময় ইতিহাস ও বর্তমান
বাংলাদেশের বরগুনা জেলার অন্তর্গত পাথরঘাটা উপজেলা, বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থিত একটি উপকূলীয় অঞ্চল। ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ উপজেলা বরিশাল বিভাগের অধীনে পড়ে। উত্তরে বামনা উপজেলা ও পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে বরগুনা সদর উপজেলা ও বিষখালী নদী, এবং পশ্চিমে বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা ও হরিণঘাটা নদী অবস্থিত। সরকার একে চর, দুর্গম ও উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭১ সালে পটুয়াখালী মহকুমা গঠিত হলে বামনা ও পাথরঘাটা মঠবাড়িয়া থানার আওতাধীন ছিল। পরবর্তীকালে একসময় পাথরঘাটা পিরোজপুর মহকুমার থানা ছিল, ১৯১৫ সালের তথ্য অনুসারে। চতুর্দশ শতাব্দীতে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল বাকেরগঞ্জের অধীনে ছিল। ১৯১০ সালে ব্রিটিশ সরকার এলাকার জমি নামজারী করে এবং ১৯২৬ সালে ঢাকা ও ফরিদপুর থেকে ব্যবসায়ীদের এনে পাথরঘাটায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ১৯৮৩ সালের ২৪শে মার্চ পাথরঘাটা উপজেলায় উন্নীত হয় এবং ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বরগুনা মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। উল্লেখ্য, পাথরঘাটার পূর্ব নাম ছিল বাধাঘাটা। পাথরঘাটা নামকরণের সঠিক ইতিহাস অস্পষ্ট হলেও, জনশ্রুতি রয়েছে যে, এলাকার ভূ-অভ্যন্তরে পাথরের অস্তিত্ব থেকেই এ নামকরণ।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও জনসংখ্যা:
পাথরঘাটা উপজেলার আয়তন ৩৮৭.৩৬ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন উচ্ছেদ করে এ উপজেলা গড়ে উঠেছে। টেংরাগিরি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য, সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন, এ উপজেলায় অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ১,৬৩,৯২৭ জন, যার মধ্যে পুরুষ ৮০,৫৪৪ জন এবং মহিলা ৮৩,৩৮৩ জন। সাক্ষরতার হার ৬৫%।
অর্থনীতি:
এটি একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চল। ধান, আলু, ডাল, সূর্যমূখী, আখ, মরিচ ইত্যাদি ফসল উৎপাদিত হয়। তবে অর্থনীতি মূলত সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের উপর নির্ভরশীল। পাথরঘাটায় মৎস্য অবতরণ ও পাইকারী বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও পাইকারী বাজার এখানেই অবস্থিত। ইলিশ, চিংড়ি পোনা প্রধান রপ্তানিদ্রব্য।
মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাথরঘাটা ৯ নম্বর সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব সেক্টরের আওতায় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা এখানে ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ১লা ডিসেম্বর রাতে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে আক্রমণ শুরু হয় এবং ২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা এলাকা দখলে নেয়। যুদ্ধাপরাধীদের গণবিচারও এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
উপকূলীয় অবস্থানের কারণে পাথরঘাটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ইত্যাদি নিত্যদিনের সমস্যা। ১৯৭০ ও ২০০৭ সালের দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য:
শিক্ষার হার ৬৫%। উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে তাসলিমা মেমোরিয়াল একাডেমী, পাথরঘাটা কে.এম. উচ্চ বিদ্যালয়, পাথরঘাটা আদর্শ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারি হাজী জালাল উদ্দিন মহিলা ডিগ্রী কলেজ, পাথরঘাটা কলেজ, সৈয়দ ফজলুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। ৫০ বেডের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে।
যোগাযোগ:
পাথরঘাটায় পাকা, আধা-পাকা এবং কাঁচা রাস্তা রয়েছে। নৌ-পথেও যোগাযোগ সম্ভব। তবে রেলপথ নেই।
সংস্কৃতি:
উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রকৃতি এর সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। নৌকা বাইচ, বৈশাখী মেলা, পৌষ সংক্রান্তি, মহরমের মেলা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা এখানে প্রচলিত। হিন্দু, মুসলিম, এবং কিছু রাখাইন (বৌদ্ধ) সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে।
উপসংহার:
বরগুনার পাথরঘাটা এক অসাধারণ উপজেলা, যার ইতিহাস, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনীতি, এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। প্রাকৃতিক ঝুঁকির মধ্যেই জীবনযাপন করে এ অঞ্চলের মানুষ। উন্নয়নের মাধ্যমে এর সম্ভাবনাকে আরও বিকশিত করা সম্ভব।