ফেনী শহর

ফেনী: ইতিহাস, ভূগোল ও সংস্কৃতির সমন্বয়

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা ফেনী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক এই জেলা দ্রুত বর্ধনশীল নগরাঞ্চল হিসেবেও পরিচিত। ফেনী নদীর তীরে অবস্থিত ফেনী শহর জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। ২৭.২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে প্রায় ২,৩৪,৩৫৮ জন মানুষ বসবাস করে। চট্টগ্রাম থেকে ৯১.৭ কিমি দূরত্বে অবস্থিত ফেনী শহরের সবচেয়ে নিকটবর্তী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলো শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

  • *নামকরণের ইতিহাস:** ফেনী নদীর নামানুসারেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে। মধ্যযুগের কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় 'ফনী' নামে একটি নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও সতের শতকে মির্জা নাথানের লেখায় 'ফনী' 'ফেনী'তে রূপান্তরিত হয়। আঠারো শতকের শেষভাগে কবি আলী রজা ও মুহম্মদ মুকিমও তাদের লেখায় 'ফেনী' নামটি ব্যবহার করেছেন।
  • *প্রাচীন ইতিহাস:** অতীতে ফেনী অঞ্চল ছিল সাগরের অংশ, তবে উত্তর-পূর্ব দিক ছিল পাহাড়ি অঞ্চলের পাদদেশ। বৃহত্তর নোয়াখালীর তুলনায় ফেনী অঞ্চলকে ভূ-খণ্ড হিসেবে অধিকতর প্রাচীন বলে মনে করা হয়। ছাগলনাইয়া উপজেলার শিলুয়া গ্রামে প্রাচীন ঐতিহাসিক শিলামূর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, যা বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টির বিকাশের ইঙ্গিত দেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বীর বাঙ্গালী শমসের গাজীর রাজধানী ছিল রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে। তিনি এখান থেকে যুদ্ধাভিযানে গিয়ে রৌশনাবাদ ও ত্রিপুরা রাজ্য জয় করেন।
  • *ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়া:** ফেনী রাজধানী ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে এবং চট্টগ্রাম থেকে উত্তরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১২ মিটার। এখানকার আবহাওয়া ক্রান্তীয় ভেজা ও শুষ্ক। গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন ১৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২৭৯৪ মিলিমিটার।
  • *জনসংখ্যা ও প্রশাসন:** ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ফেনী শহরের জনসংখ্যা ১,৫৬,৯৭১ জন। ফেনী টাউন কমিটি ১৯২৯ সালে গঠিত হয়ে ১৯৯২ সালে পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। ফেনী পৌরসভা ১৮টি ওয়ার্ড ও ৩৫টি মহল্লা নিয়ে গঠিত।
  • *মুক্তিযুদ্ধ:** ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ফেনী জেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাগলনাইয়ার শুভপুর, কালাপুল, গোপাল ইউনিয়নের দুর্গাপুর ও সিংহনগর, ফুলগাজী উপজেলার বন্দুয়া সেতু, সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর, সাতবাড়িয়া এবং পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়া বিওপি- এসব স্থানে মুক্তিযুদ্ধের তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ফেনী জেলার বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
  • *অর্থনীতি:** ফেনীর অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ধান, গম, ডাল, মিষ্টি আলু, মরিচ, আখ, চীনাবাদাম প্রধান কৃষি ফসল। এছাড়াও টেক্সটাইলমিল, স্টিলমিল, জুটমিল, অয়েলমিল, রাইসমিল, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, ঔষধ ফ্যাক্টরি, টাওয়ালস ফ্যাক্টরি ইত্যাদি কারখানা রয়েছে।
  • *সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য:** ফেনী ধাঁ-ধাঁ, কবিতা, গল্প, প্রবাদ, লোককাহিনী, পালাগান, কবিয়ালী গান, যাত্রা ইত্যাদি লোকসংস্কৃতির সমৃদ্ধ ধারক। ভেটিয়ালী, রাখালী, মারফতী, মুর্শিদী গান এখানে জনপ্রিয়। ফেনীর ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির, মাযার, দীঘি ইত্যাদি পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম।

ফেনী তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও গতিশীল অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য। এ জেলার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য আরও যথাযথ পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের প্রয়োজন।

মূল তথ্যাবলী:

  • ফেনী চট্টগ্রাম বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা
  • ফেনী নদীর তীরে অবস্থিত
  • প্রায় ২,৩৪,৩৫৮ জন জনসংখ্যা (শহর)
  • সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  • মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
  • কৃষি ও শিল্পের সমন্বিত অর্থনীতি
  • ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির ধারক

গণমাধ্যমে - ফেনী শহর