প্রবাসী: বিংশ শতাব্দীর এক অমূল্য বাংলা সাহিত্য সাময়িকী
১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে, ১৩০৮ বঙ্গাব্দে, আলো ছড়িয়ে পড়েছিল ‘প্রবাসী’ নামক একটি মাসিক পত্রিকার। এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকাটি বাংলা ভাষায় ছিল, সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং কার্যকরী সম্পাদক আশুতোষ চক্রবর্তী। বার্ষিক মূল্য ছিল আড়াই টাকা। প্রবাসী শুধু সাহিত্য নয়, শিল্প, সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি সব বিষয়কেই তার আলোকে ধারণ করেছিল।
৪০ পৃষ্ঠার প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্ত শর্মা, দেবেন্দ্রনাথ সেন, নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় ও যোগেশচন্দ্র রায়ের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। অজন্তা গুহার ছবি, জীববিজ্ঞানের নিবন্ধ, লোকসঙ্গীতের সুর – বিবিধ বিষয়ের সমন্বয়ে প্রবাসী জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৩২২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ‘হারামণি’ বিভাগের যোগে বাংলার লোকসঙ্গীত সংরক্ষণেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রকাশিত প্রবাসীতে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় নারীদের লেখায় উৎসাহ দিতেন এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের পক্ষে কথা বলতেন। তার মৃত্যুর পর পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাসী শুধু সাহিত্যের পাতা নয়, বাংলার সংস্কৃতির এক বিশাল আর্কাইভ, যেখানে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু প্রমুখ শিল্পীদের কাজও প্রকাশিত হতো। ইউরোপীয় শিল্পীর ছবিও প্রথম প্রকাশিত হয় এই পত্রিকাতেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রবাসীতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো এবং তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি পাঠকের কাছে পৌঁছেছে এই পত্রিকার মাধ্যমেই। ইতিহাস, শিল্পকলা, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, শিক্ষা, বিজ্ঞান, ভ্রমণকাহিনী – নানা বিষয়ের উপর লেখা প্রবাসীকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল।
প্রায় ৩৫০ জন লেখকের লেখা প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিল। তৎকালীন সকল প্রধান কবি ও লেখকের রচনা প্রায় সবই প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া। প্রবাসীর সম্পূর্ণ সংগ্রহ বিভিন্ন গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়, তবে এখনও কোনও নির্ঘন্ট প্রকাশিত হয়নি। প্রবাসী- বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ, বিংশ শতাব্দীর বাংলা সংস্কৃতির এক জ্বলন্ত প্রতীক।