বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট: কারণ, প্রভাব ও সমাধান
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তীব্র জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের সব ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। এই সংকটের মূলে রয়েছে বহুবিধ কারণ, যার মধ্যে রয়েছে দেশীয় উৎপাদনের অভাব, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি, এবং ডলার সংকট।
- *দেশীয় উৎপাদনের অভাব:** আগে বলা হতো বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের অভাব এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের কারণে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে। ২০১৬ সালে প্রতিদিন ২৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, যা ২০২১ সালে নেমে এসেছে ২৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুটে। হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান মজুদ দিয়ে আরও ৯ বছর চলা সম্ভব, তবে নতুন কোন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে। এছাড়াও, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের ৪০% ব্যবহৃত হয়।
- *আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি:** রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য জ্বালানি আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ২০২২ সালে, তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানিতে ১৩-১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল, যা ২০২৩ সালে ১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এলএনজি গ্যাস আমদানি এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
- *ডলার সংকট:** বাংলাদেশ বর্তমানে ডলার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হয়। ডলার সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, যা সংকট আরও তীব্র করে তুলছে। এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানিতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে।
- *সংকটের প্রভাব:** জ্বালানি সংকটের প্রভাব বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি। লোডশেডিং বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে গরমের সময়ে। শিল্প-কারখানা, পরিবহন খাত এবং সাধারণ মানুষ সবাই এর প্রভাব অনুভব করছে। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অর্থনীতির জন্য ৫টি ঝুঁকির মধ্যে জ্বালানি স্বল্পতাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
- *সমাধানের উপায়:** জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী উভয় ধরনের সমাধান প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদী সমাধান হিসেবে ডলার সংকট কাটানো, এলএনজি আমদানি বাড়ানো এবং বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে সাশ্রয় করা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জ্বালানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি করা জরুরি। পেট্রোবাংলা চলতি বছরে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেখানে আগামী চার বছরে ৪৬টি কূপ খনন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হবে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান এলাকায় বিপুল গ্যাসের মজুদের সম্ভাবনা রয়েছে, যা এখনও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সরকারের বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগও রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি।
- *সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান:** বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান (যেমন- বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড), আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (যেমন- শেল, চেভ্রন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ আমিনুর রহমান।
- *স্থান:** বঙ্গোপসাগর, বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র (সিলেট, ভোলা ইত্যাদি), মহেশখালী।
- *তথ্য:** ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ, দৈনিক ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন, দৈনিক ৩৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদা, ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের সম্ভাবনা বঙ্গোপসাগরে।
- *উপসংহার:** বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদী এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামার প্রতি সচেতন থাকা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।