কুমিল্লা নগরী: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের সম্মিলন
কুমিল্লা, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মহানগরী। গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার পর বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম শহর। কুমিল্লা শুধুমাত্র বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর নয়, বরং এটি একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, জীবন্ত সংস্কৃতি ও গতিশীল অর্থনীতির সমন্বয়ে গঠিত একটি মনোমুগ্ধকর স্থান।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
প্রাচীন বাংলার গৌরবময় ইতিহাসে কুমিল্লার অবদান অপরিসীম। একসময় এটি সমতট অঞ্চল এবং ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী ছিল। ৯ম শতকে কুমিল্লা হরিকেল রাজাদের শাসনাধীনে আসে, ৮ম শতকে দেব বংশ এবং ১০ম-১১শ শতকের মাঝামাঝি সময় চন্দ্র বংশের শাসনকাল অনুভব করে। ১৭৬৫ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসার পর ১৭৯০ সালে কুমিল্লা 'ত্রিপুরা' জেলার সদর দপ্তর হিসেবে কাজ করে। ১৯৬০ সালে জেলার নামকরণ করা হয় 'কুমিল্লা'। ১৯৮৪ সালে চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা থেকে পৃথক জেলা হিসেবে গঠিত হয়।
শমসের গাজীর ঐতিহাসিক ভূমিকা:
১৭৬৪ সালে ত্রিপুরা রাজার বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শমসের গাজী। তিনি সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সমগ্র কুমিল্লা অঞ্চলকে তার শাসনাধীনে নিয়ে আসেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লাকসাম, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, হোমনা, বেলতলী ও রসুলপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। কুমিল্লা বিভিন্ন গণকবরের স্মৃতি ধারণ করে আজও।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
কুমিল্লা ২৩°২৭′০″ উত্তর এবং ৯১°১২′০″ পূর্বে অবস্থিত। কর্কটক্রান্তি রেখা কুমিল্লা শহরের দক্ষিণ দিকে টমসম ব্রিজের উপর দিয়ে অতিক্রম করে। গোমতী ও ছোট ফেনী নদী কুমিল্লার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। ২০২২ সালের ডিজিটাল জনশুমারী অনুযায়ী কুমিল্লা আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম মহানগরী।
অর্থনীতি:
কুমিল্লার অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক, তবে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা খাতও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কুমিল্লা বিমানবন্দর এলাকায় গড়ে উঠেছে কুমিল্লার ইকোনমিক জোন (ইপিজেড) এবং বিভিন্ন শিল্প কারখানা। ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিবির বাজার স্থলবন্দর ব্যবসা বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। খদ্দর কাপড় ও রসমালাই কুমিল্লার বিখ্যাত দ্রব্য।
শিক্ষা:
কুমিল্লা শিক্ষার জন্যেও সুখ্যাত। কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড এখানে অবস্থিত। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করেছে।
পর্যটন:
কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি পাহাড়, ময়নামতি জাদুঘর, শালবন বিহার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান কুমিল্লাকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা:
কুমিল্লায় সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কুমিল্লার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।
কুমিল্লা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের এক অনন্য সম্মিলন। এই শহরটি তার গৌরবময় অতীত, বর্তমানের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।