উত্তম কুমার: বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক
উত্তম কুমার (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ - ২৪ জুলাই, ১৯৮০), প্রকৃত নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ। তাকে 'মহানায়ক' উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে তিনি স্বীকৃত। তিনি ছিলেন একজন অভিনেতা, চিত্রপ্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং গায়ক। তার তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিনীত ২০২টি ছবির মধ্যে ১৫টি হিন্দি ছবিও রয়েছে। তার অভিনয় জীবন ছিল বহুমুখী এবং বিতর্কিতও; অসংখ্য বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি তিনি সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন।
প্রাথমিক জীবন ও কর্মজীবনের আদিপর্ব:
কলকাতার ভবানীপুরের ৫১ আহিড়ীটোলা স্ট্রীটে জন্মগ্রহণকারী উত্তম কুমারের শৈশব ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। তিনি চক্রবেড়ীয়া হাই স্কুল এবং সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছেন। ছোটবেলা থেকেই নাটক ও খেলাধুলার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। তিনি মঞ্চে অভিনয় করতেন এবং হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কলেজ শেষ না করেই কলকাতা বন্দরে কেরানির চাকরি নিতে হয়। তবে তার চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ কমেনি। ১৯৪৭ সালে 'মায়াডোর' নামে একটি হিন্দি ছবিতে কাজ করেন, তবে ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৪৮ সালে 'দৃষ্টিদান' ছবি দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন। প্রথম দিকে বেশ কয়েকটি ছবি বক্স অফিসে ব্যর্থ হলেও, পরবর্তীতে 'বসু পরিবার', 'সাড়ে চুয়াত্তর' এবং 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবির মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সুচিত্রা সেনের সাথে তার অভিনয় জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্মরণীয়।
শীর্ষে আরোহণ ও স্বর্ণযুগ:
'অগ্নিপরীক্ষা'র সাফল্যের পর উত্তম কুমারের ক্যারিয়ারে কোনো পিছনে ফিরে তাকানো ছিল না। সুচিত্রা সেনের সাথে তিনি অসংখ্য ব্লকবাস্টার ছবিতে অভিনয় করেন। 'শাপমোচন', 'শিল্পী', 'হারানো সুর', 'সপ্তপদী', 'চাওয়া পাওয়া' ইত্যাদি ছবি তার অভিনয় জীবনের স্মারক। তিনি একজন জাত অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। 'তাসের ঘর', 'ঝিন্দের বন্দী', 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' ছবির মধ্যে তিনি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের 'নায়ক' এবং 'চিড়িয়াখানা' ছবিতে অভিনয় করে তিনি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন। 'এন্টনি ফিরিঙ্গি' ছবিও তার ক্যারিয়ারের এক উল্লেখযোগ্য অংশ।
ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি:
উত্তম কুমারের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল বিতর্কিত। তিনি ১৯৪৮ সালে গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন। তার একমাত্র পুত্র গৌতম চট্টোপাধ্যায়। সুচিত্রা সেন ও সুপ্রিয়া দেবীর সাথে উত্তমের সম্পর্ক ছিলো কালজয়ী। রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বন্যার সময় দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি দুঃস্থ কলাকুশলীদের জন্য 'শিল্পী সংসদ' গঠন করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
উত্তম কুমার তার অভিনয় জীবনে অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আটবার বিএফজেএ পুরস্কার এবং তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন। তার মৃত্যুর পরেও তার জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে। তার নামে পুরস্কার, মেট্রো স্টেশন, এবং মূর্তি নির্মিত হয়েছে। তাকে নিয়ে বহু বই, ম্যাগাজিন, ধারাবাহিক, এবং চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।
উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের এক অমূল্য সম্পদ, এক মহানায়ক যার অবদান চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।