ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর (১৪ এপ্রিল ১৮৯১ – ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬), যিনি বাবাসাহেব আম্বেদকর নামেও পরিচিত, ভারতের ইতিহাসের একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবহারশাস্ত্রজ্ঞ (জ্যুরিস্ট), রাজনৈতিক নেতা, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, সুবক্তা, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবী ও বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী। ভারতের সংবিধানের মুখ্য রচয়িতা হিসেবে তিনি অমর। তিনি ভারতের সংবিধানের খসড়া কার্যনির্বাহী সমিতির সভাপতিও ছিলেন। তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ২০১২ সালে হিস্ট্রি টিভি ১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা তিনি "শ্রেষ্ঠ ভারতীয়" নির্বাচিত হন।
ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ভারতের এক গরিব মাহার পরিবারে (তখন অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে গণ্য হত) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামজি সকপাল ও মাতার নাম ভীমাবাঈ। আম্বেদকর সারাজীবন সামাজিক বৈষম্যের, "চতুর্বর্ণ পদ্ধতি"-হিন্দু সমাজের চারটি বর্ণ এবং ভারতবর্ষের অস্পৃশ্যতা প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং হাজারো অস্পৃশ্যদের থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত করে খ্যাত হয়েছিলেন। আম্বেদকরকে ১৯৯০ সালে মরণোত্তর "ভারতরত্ন" – ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উপাধি –তে ভূষিত করা হয়।
বহু সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে, ভারতে কলেজ শিক্ষা অর্জনে আম্বেদকর প্রথম "দলিত ব্যক্তি" (Outcast) হিসেবে স্বীকৃতি পান। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয় (লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স) থেকে আইনে ডিগ্রি (বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি) লাভ করার পর, আম্বেদকর বিদ্বান ব্যক্তি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন এবং কিছু বছর আইন চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরে তিনি ভারতের অস্পৃশ্যদের সামাজিক অধিকার ও সামাজিক স্বাধীনতার উপর ওকালতির সময় সমসাময়িক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। কিছু ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা তিনি "বোধিসত্ত্ব" উপাধিতে সম্মানিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি নিজেকে "বোধিসত্ত্ব" হিসেবে কখনো দাবি করেননি।
মধ্য প্রদেশের মোহ অঞ্চলে ব্রিটিশ কর্তৃক স্থাপিত শহরে আম্বেদকর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি রামজী মালোজী শাকপাল এবং ভীমাবাইয়ের ১৪তম তথা সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন। তার পরিবার মারাঠী অধ্যুষিত মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলার আম্বোভাদ শহরের। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মহার জাতির অন্তর্গত ছিলেন, যারা অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে এবং প্রচণ্ড আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকার হত।
আম্বেদকরের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা এবং তার পিতা রামজী শাকপাল মোহ সেনানিবাসের ভারতীয় সেনা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতেন। আম্বেদকরকে অন্যান্য অস্পৃশ্য শিশুর মতো আলাদা করে দেওয়া হত। শিক্ষকগণ তাদের প্রতি অমনোযোগী ছিলেন এবং কোনো সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতেন না। আম্বেদকর এ অবস্থাকে "পিওন নাই, পানি নাই" বলে আখ্যায়িত করেছেন।
১৯০৩ সালে (মাত্র ১২ বছর বয়সে) আম্বেদকর বিয়ে করেন এবং পরিবারসহ মুম্বাইয়ে (তারপর বোম্বে) চলে আসেন। তিনি এলফিনস্টোন সরকারি বিদ্যালয়ের প্রথম অস্পৃশ্য ছাত্র ছিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম অস্পৃশ্য হিসেবে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। ১৯০৮ সালে তিনি এলিফিনস্টোন কলেজে ভর্তি হন এবং বারোদার রাজা গয়াকওয়াদ সায়াজী রাও তৃতীয় কর্তৃক বৃত্তি পান। ১৯১২ সালে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন।
নিউইয়র্কে তিনি লো লাইব্রেরিতে চার ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। ১৯১৬ সালে গ্রেস ইন্ন ফর ল-এ ভর্তি হন এবং লন্ডনের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বিজ্ঞান স্কুলে ডক্টরাল থিসিসের কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯২৩ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি যিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯১৯ সালে, ভারত সরকার আইন, ১৯১৯ এর প্রস্তুতিমূলক কমিটিতে সাক্ষ্য দিতে আম্বেদকরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী এবং অন্ত্যজদের জন্য কোটা সংরক্ষণের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। ১৯২০ সালে তিনি "মুকনায়ক" নামক একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। কোলহপুরের মহারাজা শাহু প্রথম আম্বেদকরের কাজে সমর্থন দেন।
১৯২২ সালে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে এমএসসি সম্পন্ন করেন এবং আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিজয়ী হন। তিনি ১৯২৭ সালে "বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা" প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি গণ আন্দোলন শুরু করেন এবং সুপেয় পানির উৎস দানে সংগ্রাম চালিয়ে যান।
১৯৩২ সালে তাকে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মহাত্মা গান্ধী অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিরোধিতা করেন। গান্ধীর উপবাসের ফলে পুনে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি ছেড়ে দেন।
আম্বেদকর ১৯৩৫ সালে মুম্বাইয়ের সরকারি আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হন। ১৯৩৬ সালে স্বনির্ভর শ্রমিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রথম স্ত্রী রামাবাই ১৯৩৫ সালে মারা যান। ১৯৩৬ সালে "দ্য এন্নিহিলেশন অব কাস্ট" বইটি প্রকাশিত হয়।
আম্বেদকর ১৯৪২ সালে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের রূপরেখা প্রণয়নে সাহায্য করেন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সংবিধান খসড়া সমিতির সভাপতি হন।
১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। আম্বেদকর ১৯৫১ সালে হিন্দু কোড বিল খসড়ার সংসদে অগ্রগতি না হওয়ায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে দুবার বার্মা সফর করেন। ১৯৫৫ সালে ভারতীয় বৌদ্ধ মহাসভা গঠন করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে তার সর্বশেষ বই "বুদ্ধ ও তাঁর ধর্ম" এর কাজ শেষ করেন। ১৪ই অক্টোবর ১৯৫৬ সালে নাগপুরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ৫ লাখের অধিক মানুষকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করেন।
৬ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে দিল্লীতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে মরণোত্তর ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আম্বেদকরের জীবন ও কর্ম ভারতের ইতিহাসে সর্বদা স্মরণীয় থাকবে।