আতশবাজি: রঙিন আলো আর শব্দের খেলা
আতশবাজি, নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রঙিন আলোর ঝলকানি আর কানে বাজে শব্দের তীব্রতা। এই আতশবাজি আসলে নিম্নমাত্রার বিস্ফোরক (pyrotechnics), যা নান্দনিক এবং বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। মূলত চারটি প্রাথমিক প্রভাব রয়েছে আতশবাজিতে: শব্দ, আলো, ধোঁয়া এবং ভাসমান উপকরণ। লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি এবং রুপোলিসহ নানান রঙের ঝলকানি সৃষ্টি করে এরা। বিশ্বজুড়ে উৎসব, খেলাধুলা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আতশবাজির ব্যবহার চোখে পড়ে।
চীন থেকে আতশবাজির যাত্রা
আতশবাজির উদ্ভাবন হয়েছিল চীনে। প্রাথমিকভাবে অশুভ আত্মাকে ভয় দেখানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হতো। চীনা নববর্ষ, মধ্য-শরৎ চাঁদ উৎসব এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে আতশবাজির ব্যবহার প্রচুর। দেখার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অজস্র পর্যটক চীনে ভিড় করেন। চীন বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম আতশবাজি প্রস্তুতকারক এবং রফতানিকারক দেশ। খ্রিস্টপূর্ব ২ শতকে চীনারা ফাঁপা বাঁশের ডাল আগুনে নিক্ষেপ করে আতশবাজির মতো শব্দ তৈরি করত। পরবর্তীতে বারুদ ব্যবহার শুরু হয়। হান রাজবংশের আমলে (২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ২২০ খ্রিস্টাব্দ) বাঁশের কাণ্ডকে আগুনে ছুড়ে মারার মাধ্যমে উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করা হতো। সং রাজবংশের আমলে (৯৬০-১২৭৯) সাধারণ মানুষ বাজার থেকে আতশবাজি কিনতে পারত। ১১১০ সনে সম্রাট হুইজং তার রাজদরবারে বিশাল আতশবাজির আয়োজন করেন।
ইউরোপে আগমন এবং জনপ্রিয়তা
১৪শ শতকে আতশবাজি ইউরোপে আসে, তবে ১৭শ শতকে তা জনপ্রিয়তা লাভ করে। পিটার দ্য গ্রেটের রাষ্ট্রদূত লেভ ইজমেলভ চীনের আতশবাজি সম্পর্কে ইউরোপে রিপোর্ট করেছিলেন যে ইউরোপের কেউ এমন আতশবাজি আগে কখনো দেখেনি। ১৭৫৮ সালে, জেসুইট ধর্মপ্রচারক পিয়ের নিকোলাস লে চেরন ডি'আইঙ্কারভিলি বেইজিং থেকে চাইনিজ আতশবাজি তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছিলেন। উনিশ শতক এবং আধুনিক রসায়নের আবিষ্কারের পূর্বে আতশবাজি ছিল তুলনামূলকভাবে নিস্তেজ। ১৭৮৬ সালে বার্থোলেট পটাশিয়াম ক্লোরেটের সাহায্যে বেগুনি রঙ তৈরির আবিষ্কার করেন। ধাতব ম্যাগনেসিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়ামের আবিষ্কার তীব্র রৌপ্য আলো উৎপন্ন করার পথ সুগম করে।
আতশবাজির রঙ ও উপাদান
আতশবাজির রঙ সাধারণত পাইরোটেকনিক স্টার দ্বারা উৎপন্ন হয়। লিথিয়াম মাঝারি লাল, রুবিডিয়াম ভায়োলেট-লাল রঙের জন্য ব্যবহৃত হয়। স্পার্কের রঙ লাল/কমলা, হলুদ/সোনালী এবং সাদা/রুপোলির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আতশবাজির ঝুঁকি ও নিরাপত্তা
আতশবাজির অপব্যবহার বিপজ্জনক। আগুনের ঝুঁকি, শব্দ দূষণ, পাখি ও পশুদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব হলো এর ক্ষতিকর দিক। অনেক দেশে আতশবাজির ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বাংলাদেশেও আতশবাজির কারণে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনার সংখ্যা উদ্বেগজনক। সুতরাং সাবধানতা ও সচেতনতার মাধ্যমে আতশবাজির ব্যবহার করা জরুরি।