সিরাজুদ্দীন হোসেন: বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ
সিরাজুদ্দীন হোসেন (১ মার্চ ১৯২৯ - ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাংলাদেশী সাংবাদিক, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। তিনি বাংলাদেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক হিসেবে পরিচিত। তার জন্ম মাগুরা জেলার শালিখা থানার শরশুনা গ্রামে। অল্প বয়সে পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি যশোর ও কলকাতার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। পরে তিনি 'আজাদ'-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার সত্যনিষ্ঠ ও নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য ১৯৫৪ সালে তাকে 'আজাদ' থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে কিছুদিন কাজ করেন এবং ১৯৫৪ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক 'ইত্তেফাক'-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। 'ইত্তেফাক'-এ কাজ করার সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৬৬ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে 'ইত্তেফাক' বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সিরাজুদ্দীন হোসেন সংবাদ সংস্থা পিপিআই-এর ব্যুরো চীফ হিসেবে কাজ করেন। 'ইত্তেফাক' পুনরায় প্রকাশিত হলে তিনি ১৯৭০ সালে এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি 'ইত্তেফাক' পত্রিকার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখি করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। তিনি গোপনে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনস্যুলেটের গোপন প্রতিবেদনটি প্রবাসী সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন, যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদর-রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাকে ঢাকার শান্তিনগর, চামেলীবাগের বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৩রা নভেম্বর ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্ত্রীর নাম নূরজাহান সিরাজী এবং তাদের আটজন পুত্র ছিল। তার পুত্রদের মধ্যে শাহীন রেজা নূর 'প্রজন্ম ৭১'-এর সভাপতি ছিলেন।
তার সাহসী ও দেশপ্রেমিক জীবন ও অবদান বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।