সাবিনা ইয়াসমিন: বাংলাদেশের স্বর্ণকণ্ঠ
৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণকারী সাবিনা ইয়াসমিন বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক গানের সেরা কণ্ঠশিল্পী। বাংলা চলচ্চিত্রের নেপথ্য সঙ্গীতের অমিত সম্পদ তিনি। শুধু চলচ্চিত্রের গানই নয়, দেশাত্মবোধক, উচ্চাঙ্গ, ধ্রুপদী ও আধুনিক বাংলা গানেও তার অবদান অসাধারণ। তার স্বর্ণকণ্ঠে মুখরিত হয়েছে হাজার হাজার গান। ১৪ টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও ৬টি বাচসাস পুরস্কার তার অর্জনের সাক্ষী। শিল্পকলায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন, যা একজন শিল্পীর জন্য সর্বোচ্চ সম্মান।
সাতক্ষীরায় পৈতৃক বাড়ি হলেও, নারায়ণগঞ্জে বেড়ে ওঠা সাবিনার শৈশব গানের পরিবেশেই কেটেছে। তার বাবা লুতফর রহমান ব্রিটিশ রাজের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, আর মা বেগম মৌলুদা খাতুন ছিলেন একজন গানের শিক্ষার্থী। তার চার বোন- ফরিদা, ফৌজিয়া, নীলুফার এবং নাজমা- সঙ্গীতের সাথে জড়িত ছিলেন। সাবিনা মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে গান গেয়েছিলেন, এবং ১৯৬৪ সালে বেতারের 'খেলাঘর' অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। ওস্তাদ পি.সি. গোমেজের কাছে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন। আলতাফ মাহমুদ তার গানের প্রতিভাকে চিনে তার চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন।
১৯৬৭ সালে 'আগুন নিয়ে খেলা' চলচ্চিত্রের 'মধুর জোছনা দীপালি' গানের মাধ্যমে তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭২ সালে 'অবুঝ মন' চলচ্চিত্রের 'শুধু গান গেয়ে পরিচয়' গান তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। 'সুজন সখী', 'গোলাপী এখন ট্রেনে', 'সুন্দরী', 'কসাই' -এর মতো চলচ্চিত্রের গানে তার কণ্ঠ কত জনপ্রিয় হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। ১৯৮০-এর দশকে তার গাওয়া 'জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো', 'আমি রজনীগন্ধা ফুলের মত' ও 'চিঠি দিও প্রতিদিন' গানগুলো অসাধারণ জনপ্রিয়তা পায়। তিনি আর ডি বর্মণ, কিসোর কুমার, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, আলাউদ্দীন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, খান আতাউর রহমান প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেছেন। 'দাঙ্গা', 'রাধা কৃষ্ণ', 'দুই দুয়ারী', 'দুই নয়নের আলো', 'দেবদাস' -এর মতো চলচ্চিত্রের গানেও তার কণ্ঠ ছিলো অমোঘ। তার সর্বশেষ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র 'পুত্র'।
দেশাত্মবোধক গানেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য। 'জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো', 'সব ক’টা জানালা খুলে দাও না', 'ও আমার বাংলা মা' -এর মত গান সবার কাছে পরিচিত। তিনি চ্যানেল আইয়ের 'সেরা কণ্ঠ' অনুষ্ঠানে বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার স্বামী প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন। তিনবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি একটি কন্যা ফাইরুজ ইয়াসমিন ও এক পুত্র শ্রাবণকে জন্ম দিয়েছেন। তিনি ইংল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, হংকং, আমেরিকা, বাহরাইন সহ বিভিন্ন দেশে গান পরিবেশন করেছেন।
সাবিনা ইয়াসমিন শুধু একজন গায়িকা নন, তিনি একজন প্রতিভাবান শিল্পী যিনি তার সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছেন। তার গান যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে বাস করবে।