বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা: একটি দীর্ঘ ইতিহাস
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন সহিংসতার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও জটিল। পাকিস্তান আমল থেকেই শুরু হওয়া এই সহিংসতার ধরন ও তীব্রতা কালক্রমে বদলেছে, তবে এর মূলে রয়েছে রাজনীতি, আদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং প্রশাসনের দুর্বলতা।
ব্রিটিশ আমলে ছাত্র রাজনীতি ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ, কিন্তু সহিংসতার ঘটনা ছিল বিরল। পাকিস্তান আমলে আঞ্চলিক চেতনার উত্থান এবং রাজনৈতিক দলের প্রভাবের ফলে শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতার সূচনা হয়। আইয়ুব খানের আমলে গঠিত এনএসএফ-এর মতো সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্র আন্দোলন দমনে কাজ করে। ১৯৬৮ সালে এনএসএফ এর সন্ত্রাসী ক্যাডার সাইদুর রহমানের মৃত্যু এই সহিংসতার একটি প্রারম্ভিক উদাহরণ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আদর্শগত ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব শিক্ষাঙ্গনে নতুন করে সহিংসতা বৃদ্ধি করে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলে ৭ জন ছাত্রের হত্যা এই সময়কালের ভয়াবহ ঘটনা। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে এই সহিংসতা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং ১৯৯৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সর্বাধিক সংঘাতপূর্ণ শিক্ষাঙ্গন হিসেবে চিহ্নিত করে।
জনকণ্ঠের ২০০১ সালের একটি জরিপ অনুসারে ১৯৭৪ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে শিক্ষাঙ্গনে ১২৮ জনের মৃত্যু এবং ৪২৯০ জনের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই সহিংসতার শিকার হয়েছে। ছাত্রলীগ, এই সহিংসতার সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত সংগঠন।
সহিংসতার কারণ হিসেবে উপদলীয় দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার ব্যবসা, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়। এই সহিংসতায় রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র ক্যাডারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের দুর্বলতা এবং গডফাদারদের প্রভাবের কারণে এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রীদের উপর হামলা, ধর্ষণ, অপহরণ ও যৌন নির্যাতনের মতো নতুন ধরণের সহিংসতা শিক্ষাঙ্গনে দেখা দিয়েছে।
শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের কার্যকর ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা, এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরী। এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধানে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণই কেবলমাত্র একটা সুন্দর ও সহিংসতা মুক্ত শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করতে পারবে।