মানি লন্ডারিং

মানি লন্ডারিং বা অর্থশোধন হলো অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম, যেখানে অবৈধ সম্পদের উৎস গোপন করার জন্য সম্পদের আংশিক বা পুরো অংশ রুপান্তর করা হয় অথবা বৈধ জায়গায় বিনিয়োগ করা হয় যাতে আয় বৈধ বলে মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের সহায়তায় এ কার্যক্রম চলে। এটি একটি ফৌজদারী অপরাধ।

একটি খাতের টাকা অন্য খাতে নেওয়া, পর্যায়ক্রমে খাত পরিবর্তন করে এমন অবস্থা তৈরি করা হয় যাতে মূল উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অবৈধ উৎস শনাক্ত করতে পারে না। এর কারণ অর্থের মালিক টাকা খরচ করতে পারে না, কারণ তাহলে সে আইনের হাতে ধরা পড়তে পারে। মাদক কারবারী, অসৎ রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তারা এ পন্থা অবলম্বন করে।

মানি লন্ডারিং শব্দটি কালো টাকা বৈধ করার প্রক্রিয়া বর্ণনা করে। বেআইনিভাবে অর্জিত অর্থের উৎস লেনদেনের মাধ্যমে গোপন করা হয়, যাতে শেষ পর্যন্ত তা বৈধ আয় হিসেবে দেখানো যায়।

মানি লন্ডারিং ও মানি স্মাগলিং এক নয়। লন্ডারিং হলো পাচারকৃত অর্থকে বৈধ দেখানোর একটি প্রক্রিয়া। 'মানি লন্ডারিং' শব্দের অর্থ 'টাকা পরিষ্কার করা'। তবে এর পারিভাষিক অর্থ হলো অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে উপার্জিত অবৈধ টাকাকে বৈধ করার প্রক্রিয়া।

ভারতের প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ এর ধারা ২(p) এ মানি লন্ডারিং এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি অপরাধের উপার্জনের সাথে জড়িত থাকে এবং তা অবিকৃত সম্পত্তি হিসেবে চরিতার্থ করার চেষ্টা করে, অথবা জানাজানি সহায়তা করে, সে অর্থশোধনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে।

মানি লন্ডারিং হলো ‘ফাইনান্সিয়াল ডিটারজেন্ট’। এর প্রাথমিক উৎস খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারের জন্য অবৈধ উপার্জনকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা সম্ভব হয় না। কার ফাঁকিদাতা থেকে মাদক পাচারকারী সবাই এ মাধ্যম ব্যবহার করে।

মানি লন্ডারিং এর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য: (১) অবৈধ আয়ের উৎস গোপন করা (২) আয়কর ফাঁকি দেওয়া।

সাধারণত তিনটি প্রক্রিয়ায় মানি লন্ডারিং করা হয়: (১) প্লেসমেন্ট: অবৈধ টাকা অর্থ ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো। (২) লেয়ারিং: জটিল লেনদেনের মাধ্যমে অর্থের উৎস গোপন করা। (৩) ইন্টিগ্রেশন: অবৈধ অর্থকে বৈধ বলে দেখানো।

মানিলন্ডারিং এর প্রথম ধাপ হলো অবৈধ টাকা অন্য দেশে পাচার করা। দেশ থেকে বিদেশে আইন বহির্ভূতভাবে অর্থ পাচার করা হয়, পরে তা বৈধ করা হয়। বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ধারা ২ অনুসারে অর্থ বা সম্পত্তি পাচারের সংজ্ঞা দেওয়া আছে।

অর্থ পাচার নানাভাবে হয়। বাণিজ্য কারসাজি (ওভার/আন্ডার ইনভয়েসিং, পণ্য রদবদল), ব্যাংকের সাথে মিলে কারসাজি, রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনা, উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ কারসাজি ইত্যাদি। হুন্ডি, কর বা শুল্ক ফাঁকি দেওয়াও অর্থ পাচারের মাধ্যম।

অধিকাংশ দেশে মানি লন্ডারিং ফৌজদারী অপরাধ। বিশ্বের প্রায় সকল দেশ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আইন করেছে।

বাংলাদেশে ২০০২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়, পরে ২০১২ সালে নতুন আইন হয়। আইন প্রয়োগের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। আইনে ২৮টি সম্পৃক্ত অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে কাজ করে। শাস্তি: ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৪-১২ বছর কারাদন্ড ও অর্থদণ্ড, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অর্থদণ্ড ও নিবন্ধন বাতিল।

ভারতে ২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২ পাশ হয়। ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন 'চতুর্থ অ্যান্টি মানি লন্ডারিংয়ের নির্দেশিকা' প্রবর্তন করে। যুক্তরাজ্যে পাঁচটি প্রাথমিক আইন আছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরোধমূলক ও অপরাধমূলক ব্যবস্থা আছে।

সরকারও কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়, যার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

মূল তথ্যাবলী:

  • মানি লন্ডারিং হলো অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেখানে অবৈধ সম্পদের উৎস গোপন করা হয়।
  • এটি একটি ফৌজদারী অপরাধ এবং ব্যাংকের সহায়তায় ঘটতে পারে।
  • মূল উৎস গোপন করার জন্য জটিল লেনদেনের মাধ্যমে অর্থের খাত পরিবর্তন করা হয়।
  • বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর মাধ্যমে এ অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
  • বিশ্বের অনেক দেশেই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কঠোর আইন রয়েছে।