ভোলা

ভোলা: বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীদ্বীপের গৌরবময় ইতিহাস ও বর্তমান

বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত ভোলা জেলা, দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা হিসেবে পরিচিত। এটি মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় অবস্থিত বৃহৎ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্য ভোলা দেশের মানচিত্রে স্বতন্ত্র স্থান ধারণ করেছে।

  • *ভোলার নামকরণ:** স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, বেতুয়া নদীতে (বর্তমানে বেতুয়া খাল) খেয়া নৌকার মাঝি ‘ভোলা গাজি’র নামানুসারেই এ অঞ্চলের নামকরণ হয় ‘ভোলা’। এর পূর্বে এটি ‘দক্ষিণ শাহবাজপুর’ নামে পরিচিত ছিল।
  • *ঐতিহাসিক গুরুত্ব:** ভোলার ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ। ১৫০০ সালে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা এখানে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৫১৭ সালে জন ডি সিলবেরা নামক পর্তুগিজ জলদস্যু এ দ্বীপটি দখল করেছিলেন। মনপুরা দ্বীপ ছিল তাদের দস্যুতার আখড়া। আরাকানের বর্গী ও মগরাও দক্ষিণ শাহবাজপুরে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই সময়ের এক প্রচলিত জনকথার কবিতাটি হলো:

‘‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিব কিসে?

ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কী?

আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।’’

১৮২২ সাল পর্যন্ত শাহবাজপুর বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ ছিল। ১৮৪৫ সালে নোয়াখালী জেলার অধীনে মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৮৬৯ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৮৭৬ সালে দৌলতখান হতে ভোলা শহরে সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হয়। অবশেষে ১৯৮৪ সালে ভোলা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে গঠিত হয়।

  • *ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:** ভোলা ২২°৪১′০৯″ উত্তর ৯০°৩৮′৪৬″ পূর্ব অক্ষাংশে অবস্থিত। এটি সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র ১ মিটার উঁচু। ২০০১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৪ লক্ষ, ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ১৭ লক্ষের উপরে।
  • *অর্থনীতি:** ভোলার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। ধান, গম, আলু, ডাল, শাকসবজি প্রধান ফসল। মৎস্য ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনেও ভোলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মহিষের দই ভোলার একটি বিখ্যাত পণ্য। ‘দধি, মামলা, গোলা, এই তিনে ভোলা’ এই কথাটি বহুল প্রচলিত।
  • *সংস্কৃতি:** ভোলার সংস্কৃতি বরিশাল, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর মিশ্র সংস্কৃতির প্রতিফলন বহন করে। এখানে পল্লীগীতি, লালন গীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, পালাগান, কবিগান, শিবের গাজন, মারফতি, হালখাতা, দুর্গাপূজা, চড়কপূজা সহ নানা ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচলিত। ভোলায় বেশ কিছু সংগীত, নাটক ও সাহিত্য সংগঠনও রয়েছে।
  • *মুক্তিযুদ্ধ:** ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভোলায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ করেছিলেন। ঘুইংগার হাট, টনির হাট (বর্তমান বাংলাবাজার) সহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়।
  • *দর্শনীয় স্থান:** চর কুকরী-মুকরী, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর, মনপুরা দ্বীপ ভোলার কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।

ভোলা, একটি দ্বীপ জেলা হলেও, এর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সমন্বয়ে এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভবিষ্যতে ভোলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন আরও বেগবান হবে বলে আশা করা যায়।

মূল তথ্যাবলী:

  • ভোলা বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা
  • বেতুয়া নদীর মাঝি ভোলা গাজির নাম থেকে ভোলার নামকরণ
  • ১৫০০ সালে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুর আক্রমণ
  • ১৯৮৪ সালে ভোলা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে গঠন
  • মহিষের দইয়ের জন্য বিখ্যাত
  • কৃষি ও মৎস্য অর্থনীতির মূল ভিত্তি
  • সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য