ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার সমাহার
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হল সরাইল। ২১৫.২৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলা ২৪°০০´ থেকে ২৪°১১´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°৫৯´ থেকে ৯১°১৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। উত্তরে নাসিরনগর, দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও নাসিরনগর এবং পশ্চিমে ভৈরব ও বাজিতপুর উপজেলায় সরাইলের সীমানা বিস্তৃত। মেঘনা, তিতাস, বগদিয়া ও ভৈরব নদীর উপস্থিতি সরাইলের ভৌগোলিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে। আকাশী বিল ও শাপলা বিল এখানকার উল্লেখযোগ্য জলাশয়।
জনসংখ্যার দিক থেকে সরাইল উপজেলা বেশ জনবহুল। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এখানকার জনসংখ্যা ৩১৫২০৮; যার মধ্যে পুরুষ ১৫২৩৮৯ এবং মহিলা ১৬২৮১৯। ধর্মীয়ভাবে, ২৯১৮১৬ জন মুসলিম, ২৩৩৩২ জন হিন্দু, এবং অতি সামান্য সংখ্যক বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বাসিন্দা রয়েছে।
১৯৯০ সালে সরাইল উপজেলা গঠিত হয়। ঐতিহাসিক দিক থেকে সরাইল বেশ সমৃদ্ধ। হাটখোলা জামে মসজিদ (সপ্তদশ শতাব্দী), সরাইল শাহী জামে মসজিদ (মুগল আমল), আরিফাইলের সাগরদীঘি মসজিদ (ষোড়শ শতাব্দী), জোড়া কবর, বারিউরার হাতিরপুল জামে মসজিদ (মুগল আমল), এবং হাবলিপাড়ার ইদারা (মুগল আমল) এই অঞ্চলের প্রাচীন নিদর্শন ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক।
মুক্তিযুদ্ধে সরাইল উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিটঘর এলাকায় পাকবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হন ৮০ জন নিরীহ মানুষ। শাহবাজপুর পাকসেনা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। কালীকচ্ছ বাজারের মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সরাইলের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিহত হন।
শিক্ষার দিক থেকে, সরাইল উপজেলার শিক্ষার হার ৪০.৯%। এখানে ২টি কলেজ, ১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭টি কিন্ডারগার্টেন এবং ১২টি মাদ্রাসা রয়েছে। সরাইল ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, শাহবাজপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় এবং চুন্টা এসি একাডেমি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অর্থনীতিতে, কৃষি সরাইলের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি। ধান, গম, পাট, সরিষা, ডাল এবং শাকসবজি এখানকার প্রধান কৃষি ফসল। মৎস্য, গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগির খামার ও উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন কুটিরশিল্প যেমন লৌহশিল্প, মৃৎশিল্প, তাঁতশিল্প, সূচিশিল্প, বাঁশ ও বেতের কাজ এখানকার মানুষের জীবিকার অংশ।
সরাইল উপজেলায় ১৭টি হাটবাজার ও ৪টি মেলা রয়েছে। সরাইল বিকাল পাকশিমুল বাজার, তাডিউড়া বাজার, কালীকচ্ছ বাজার, গরুর হাট এবং বাঘাচাঁন মিয়ার মেলা, শাহবাজপুর মেলা ও গাজীকালুর বারুণী মেলা উল্লেখযোগ্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিক থেকে, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প, ১৯৮৩ এবং ২০০৪ সালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৫৪ সালের মন্বন্তর এবং বন্যায় সরাইল উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্র্যাক ও আশা সহ বিভিন্ন এনজিও এখানকার উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে। সরাইল উপজেলা একটি ঐতিহ্যবাহী, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এবং সম্ভাবনাময় অঞ্চল।