বিনিয়োগ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি
বিনিয়োগ, অর্থনীতির প্রাণশক্তি, একটি দেশের অগ্রগতির অন্যতম নির্ণায়ক। এটি কেবলমাত্র অর্থের প্রবাহ নয়, বরং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিনিয়োগের ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
- *ইতিহাসের পাতা:** ১৮২২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য সোসাইটি জেনারেল দে বেলজিক’ কে বিশ্বের প্রথম বিনিয়োগ কোম্পানি হিসেবে ধরা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়নের সাথে সাথে বিনিয়োগের বিকাশ ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিকিউরিটি বিক্রয়ের কোন অনুমতি না থাকায় ইউরোপীয় ধাঁচের বিনিয়োগ কোম্পানি সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৩৩ সালে ‘গ্লাস স্টিগেল অ্যাক্ট’ পাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ ব্যাংকিংকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে আলাদা করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে ‘বিনিয়োগ বোর্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ (BIDA) হিসেবে নতুন রূপ পায়।
- *বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি:** বাংলাদেশে দুই ধরণের বিনিয়োগ কোম্পানি আছে: মিউচুয়াল ফান্ড এবং নির্দিষ্ট কোম্পানির শেয়ার বিক্রয়কারী। বাংলাদেশ বিনিয়োগ সংস্থা (আইসিবি) দেশের মূলধন বাজার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আইসিবি ১৯৮১ সালে ‘ইউনিট ফান্ড স্কিম’ চালু করে, এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট আটটি মিউচুয়াল ফান্ড ছেড়েছে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিনিয়োগ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
- *প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI):** বাংলাদেশে FDI’র প্রবাহ সর্বদা উৎসাহজনক ছিল না। তৈরি পোশাক শিল্প এতে অগ্রণী, কিন্তু মূলধনের পরিমাণের দিক থেকে ভোগ্যপণ্য উৎপাদন খাত আগে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জাতীয়করণ নীতির কারণে নতুন FDI ঘটেনি। ১৯৯০-এর দশক থেকে FDI বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বর্তমানে তৈরি পোশাক, বস্ত্রশিল্প, রসায়ন, তেল ও গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি খাতে FDI বেশি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমাতে ‘বহুপাক্ষিক বিনিয়োগ গ্যারান্টি সংস্থা (MIGA)’ এবং ‘বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ কর্পোরেশন (OPIC)’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকার কর অবকাশ, শুল্ক রেয়াতি ইত্যাদি প্রণোদনা দিচ্ছে।
- *সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ:** অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিকতা, দুর্নীতি, অবকাঠামোগত সমস্যা, বিদ্যুৎ সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি FDI-এর প্রধান অন্তরায়। দক্ষ জনবলের অভাবও একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা।
- *ভবিষ্যতের দিক:** বাংলাদেশ সরকার ব্যবসা সহজীকরণে কাজ করছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (EPZ) স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ। সন্তোষজনক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সস্তা শ্রমশক্তি এবং বাজারের সম্ভাবনা FDI আকর্ষণে সহায়ক। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন এবং দক্ষ জনবল তৈরি অত্যন্ত জরুরি।