বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্প: একটি বিশ্লেষণ
পুরকৌশল ও স্থাপত্যবিদ্যায়, নির্মাণ বলতে একটি কাঠামো তৈরি বা জোড়া লাগানোর প্রক্রিয়া বোঝায়। এটি একক কাজ নয়, বরং বিভিন্ন কাজের সমন্বয়। একজন প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বে নির্মাণ ব্যবস্থাপক, নকশা ব্যবস্থাপক, প্রকৌশলী, এবং প্রকল্প প্রকৌশলীরা কাজটি পরিচালনা করেন। যে কোন প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করে কার্যকর পরিকল্পনার উপর। পরিবেশগত প্রভাব, সময় নির্ধারণ, বাজেট, নিরাপত্তা, উপকরণের প্রাপ্যতা, এবং জনগণের অসুবিধা- সব বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন।
জাহাজ নির্মাণ: বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত
বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিশাল নদী ও সমুদ্রপথ জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। দেশের প্রায় দশ হাজার জাহাজ পণ্য ও যাত্রী পরিবহণে ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে ৯০% তেলজাত দ্রব্য, ৭০% মালামাল, এবং ৩৫% যাত্রী পরিবহন করে। এই শিল্পে দেড় লক্ষাধিক দক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত। সম্প্রতি ডেনমার্কে সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছে। অনেক জাহাজ নির্মাণ কারখানা এখন দশ হাজার টন ধারণক্ষমতার জাহাজ তৈরি করতে সক্ষম।
ঐতিহাসিক দিক
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণের ঐতিহ্য রয়েছে। চট্টগ্রাম ছিল কাঠের জাহাজ নির্মাণের প্রধান কেন্দ্র। পঞ্চদশ ও সপ্তদশ শতকে চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণকারীরা তুরস্কের সুলতানের জন্য পুরো ফ্লিট তৈরি করেছিল। মুগল আমলেও বাংলা জাহাজ নির্মাণের খ্যাতি ছিল। উনিশ শতকের শেষভাগে লৌহ নির্মিত যুদ্ধ জাহাজ তৈরি শুরু হয়। বিশ শতকে সরকারি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৯ সালে নারায়ণগঞ্জ হাইস্পিড শিপইয়ার্ড বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অনুদানে খাদ্য বহনযোগ্য জাহাজ নির্মাণ করে। নব্বইয়ের দশকে হাইস্পিড শিপইয়ার্ড জাপানের সাথে যৌথ উদ্যোগে গভীর সমুদ্রগামী মাছ ধরা ট্রলার তৈরি করে। আনন্দ শিপইয়ার্ড এবং ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড আধুনিক জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে। ২০০৮ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে প্রথম সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে।
বর্তমান অবস্থা ও প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশতাধিক শিপইয়ার্ড ও শতাধিক মেরিন ওয়ার্কশপ রয়েছে। ৭০% ঢাকা ও আশেপাশে, ২০% চট্টগ্রামে, এবং ১০% খুলনা ও বরিশালে অবস্থিত। এগুলো ৩৫০০ টন ধারণক্ষমতার জাহাজ তৈরি করতে সক্ষম। বেশিরভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন। বছরে গড়ে ২৫০ টি নতুন জাহাজ নির্মিত হয়। কিছু শিপইয়ার্ড ১০,০০০ টন ধারণক্ষমতার জাহাজ তৈরি করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রায় ৫০,০০০ দক্ষ ও ১০০,০০০ আধাদক্ষ কর্মী নিয়োজিত আছে। আনন্দ শিপইয়ার্ড ও ওয়েস্টার্ন মেরিন লিমিটেড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শ্রমিকদের কার্যক্ষমতা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম, কিন্তু শ্রম ব্যয় সর্বনিম্ন। রপ্তানিযোগ্য জাহাজের খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি, কারণ আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের উপর কর আরোপ করা হয়।
বিশ্ববাজারে অবস্থান
প্রথম মহাযুদ্ধের পর আমেরিকা, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন জাহাজ নির্মাণ শিল্পে নেতৃত্ব দিয়েছিল। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া বৃহৎ তেলবাহী জাহাজ নির্মাণে শীর্ষস্থানে রয়েছে। চীন সূলভ মূল্যের শ্রমের কারণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভারত ও ভিয়েতনামও উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সস্তা শ্রমের দেশগুলি এই শিল্পে এগিয়ে আছে। বিশ্বে জাহাজ নির্মাণের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু শিপইয়ার্ডের সংখ্যা বাড়ছে না। আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার নিয়মের কারণে পুরাতন জাহাজ মেরামত করা কঠিন হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসেবে, বিশ্বের জাহাজ নির্মাণ বাজারের মোট পরিমাণ ১৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ যদি ১% আয়ত্ত করতে পারে, তবে তা ১৬ বিলিয়ন ডলার হবে। আনন্দ শিপইয়ার্ড ও ওয়েস্টার্ন মেরিন ০.৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। ছোট ও মাঝারি জাহাজের বাজার চাঙ্গা। বাংলাদেশ ছোট ও মাঝারি জাহাজ নির্মাণে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রাখে। বিশ্ব মন্দার সময় ছোট ও মাঝারি জাহাজের চাহিদা বেশি, ফলে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের নতুন জাহাজ নির্মাণের ০.৮৪% উৎপাদন করেছে, যার মূল্য প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রতিবন্ধকতা
জাহাজ নির্মাণ উচ্চ মূলধনের শিল্প। বাংলাদেশে এখনও জাহাজ নির্মাণ শিল্প আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়।