নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম: বিদ্রোহী কবি ও বাংলার বুলবুল

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ - ২৯ আগস্ট ১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী বাঙালি কবি। তিনি কেবলমাত্র কবিই ছিলেন না, ছিলেন সুরকার, গীতিকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী - একজন সর্বোঙ্গী প্রতিভা। তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম ছিল অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।

  • *প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা:**

১৮৯৯ সালের ২৪শে মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী ফকির আহমদের ঘরে জন্ম নেয় নজরুল। পিতা ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাযারের খাদেম। নজরুলের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। পিতার মৃত্যুর পর (১৯০৮) তিনি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য হাজী পালোয়ানের মাযারে সেবা ও মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। গ্রামের মকতব থেকে নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এসব অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

  • *সামরিক জীবন ও সাহিত্যে আবির্ভাব:**

১৯১৭ সালের শেষদিকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে নজরুলের জীবনে নতুন মোড় আসে। আড়াই বছরের সামরিক জীবন কাটান তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টে, সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করেন। করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীনই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ (১৯১৯) তার প্রথম গদ্য রচনা এবং ‘মুক্তি’ (১৯১৯) প্রথম প্রকাশিত কবিতা।

  • *সাহিত্যকর্ম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড:**

১৯২০ সালে কলকাতায় ফিরে তিনি সক্রিয় সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে তিনি পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪), ‘ভাঙ্গার গান’ (১৯২৪) তার বিখ্যাত রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য তাঁকে বহুবার গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং জেল খাটতে হয়েছিল। তাঁর প্রায় চল্লিশ দিনব্যাপী অনশন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ ছিল। নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন।

  • *সঙ্গীত ও গানের জগতে নজরুল:**

নজরুল বাংলা সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারায় নতুনত্ব এনেছেন। তিনি বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ‘নজরুলসঙ্গীত’ বাংলা সঙ্গীতের একটি অমূল্য সম্পদ। তার গানগুলো রাষ্ট্রীয় সংগ্রাম, প্রেম, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা – বিভিন্ন বিষয়কে ধারণ করে। তিনি বাংলা গজলের জনক।

  • *রাজনৈতিক জীবন:**

নজরুল অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙ্গল’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

  • *পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু:**

১৯৪২ সালের পর থেকে নজরুল অসুস্থতার কারণে নির্বাক ও সম্বিতহারা হয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকারের অনুমতি ক্রমে তাঁকে বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে তাঁকে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করা হয় এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মূল তথ্যাবলী:

  • কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
  • তিনি বিদ্রোহী কবি ও বুলবুল নামে খ্যাত।
  • তার সাহিত্যকর্ম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসের অংশ।
  • নজরুল বাংলা গানের বিভিন্ন ধারায় নতুনত্ব এনেছেন।
  • তিনি বাংলা গজলের জনক।