জাহাজ: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান
জাহাজ, নদী ও সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী বৃহদাকার নৌযান, যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আধুনিক সভ্যতায় এর অবদান অপরিসীম। নৌপরিবহন এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা। পূর্বের সরল নৌকা থেকে বর্তমানে অত্যাধুনিক, পানির নিচে চলাচলের ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজের উদ্ভাবন মানব সভ্যতার অগ্রগতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আর্কিমিডিসের তত্ত্ব অনুযায়ী, তরলে নিমজ্জিত বস্তু উপরের দিকে যে বল অনুভব করে তা বস্তুটি দ্বারা অপসারিত তরলের ওজনের সমান। এই নীতির উপর ভিত্তি করে জাহাজের ভেতরে ফাঁকা স্থান রেখে এর ঘনত্ব অপসারিত পানির ঘনত্বের চেয়ে কম করা হয়, ফলে জাহাজ ভেসে থাকে।
প্রথম জলযানের উদ্ভাবন প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে বলে অনুমান করা হয়। অধিকাংশ সমুদ্রগামী জাহাজের গড় আয়ু ২০-৩০ বছর হলেও, কাঠ কিংবা কাচতন্তু দিয়ে তৈরি জাহাজ ৪০ বছর পর্যন্ত টেকে। ইস্পাতের জাহাজ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে শতাধিক বছর চালু থাকতে পারে। নষ্ট জাহাজ জাহাজভাঙা কারখানায় (শিপব্রেকার) পাঠানো হয়, কিছু জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। অগ্নিকাণ্ড, সংঘর্ষ, এবং ডুবে যাওয়ার ফলে অনেক জাহাজের জীবনকালের অকালে মৃত্যু হয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মহাসাগরের তলদেশে ৩০ লক্ষেরও অধিক জাহাজের ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান।
- *বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প:**
বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। নদীমাতৃক দেশে প্রায় ১০,০০০ অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত। এই শিল্পে দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মরত। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণের ইতিহাস প্রাচীন; চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে এই শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। মুঘল আমলে বাংলার জাহাজ নির্মাণের খ্যাতি ছিল বিখ্যাত। উনিশ শতকের শেষভাগে কাঠের জাহাজের স্থলে লৌহ নির্মিত যুদ্ধজাহাজ তৈরি শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের হাইস্পিড শিপইয়ার্ড খাদ্য বহনকারী জাহাজ নির্মাণ করে। বর্তমানে আনন্দ শিপইয়ার্ড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণে সক্ষম। ২০০৮ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে প্রথম সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে।
বাংলাদেশে প্রায় ৫০টি শিপইয়ার্ড এবং শতাধিক মেরিন ওয়ার্কশপ কর্মরত। বেশিরভাগ শিপইয়ার্ড স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে। তবে দেশের কিছু শিপইয়ার্ড ১০,০০০ টন ধারণক্ষমতার জাহাজ তৈরির ক্ষমতা অর্জন করেছে। শ্রম ব্যয় তুলনামূলক কম হলেও, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং কাঁচামালের উপর নির্ভরতার কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে আরও উন্নত হতে হবে।
- *জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ভবিষ্যৎ:**
বিশ্ববাজারে জাহাজের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের জাহাজের। বাংলাদেশের ছোট ও মাঝারি জাহাজ নির্মাণের ক্ষমতা এই বাজারে একটি সুযোগ তৈরি করেছে। তবে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, মূলধন বিনিয়োগ, এবং কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন। বিশ্ব মন্দার সময় এই শিল্প তুলনামূলক নিরাপদ থাকে।