জলরঙ: এক অপরিসীম রঙের জগৎ
জলরঙ (Watercolor/Watercolour) হলো এক অনন্য চিত্রকর্মের মাধ্যম, যেখানে পানিতে মিশে রঞ্জক পদার্থ দিয়ে রঙ তৈরি করা হয়। এটি শুধুমাত্র একটি মাধ্যম নয়, বরং এর ফলে সৃষ্ট শিল্পকর্মও জলরঙ নামেই পরিচিত। উচ্চমানের গুঁড়া রঞ্জক, আরবীয় গাম এবং গ্লিসারিনের মিশ্রণে এ রঙ তৈরি হয়। আরবীয় গাম রঞ্জকগুলোকে একসাথে ধরে রাখে এবং গ্লিসারিন রঙের জমাট বাঁধা রোধ করে।
জলরঙের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। পুরাতন পাথরযুগের ইউরোপীয় গুহাচিত্র থেকেই এর ব্যবহারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মিশরীয় যুগ থেকেই পাণ্ডুলিপি সাজাতে জলরঙ ব্যবহার করা হতো। তবে একটা স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে জলরঙের ধারাবাহিক ইতিহাস রেনেসাঁ যুগ থেকেই শুরু হয়। জার্মান নর্দার্ন রেনেসাঁর শিল্পী আলব্রেখ্ট ডুরার (১৪৭১-১৫২৮) বোটানিক্যাল, বন্যপ্রাণী ও ল্যান্ডস্কেপের অনেক সুন্দর জলরঙ চিত্র এঁকেছেন যা জলরঙের প্রাচীনতম উদাহরণগুলির মধ্যে একটি। হান্স বোল (১৫৩৪-১৫৯৩) ডুরারের রেনেসাঁর অংশ হিসেবে জার্মানিতে জলরঙের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্কুলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
জলরঙ চিত্রকর্ম মূলত দুই প্রকার: স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ। অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে টেম্পারা ও গোয়াশ ব্যবহার করা হয়। আঠারো শতকের শেষের দিকে ইংল্যান্ডে জলরঙের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বিলাসী শ্রেণীর মানুষের কাছে এটি শিক্ষার একটি অংশ হয়ে ওঠে। মানচিত্রকার, সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রকৌশলীরা এটি ভূমি, দুর্গ, ভূতত্ত্ব ও প্রকল্পের চিত্র তৈরির জন্য ব্যবহার করত। জলরঙ শিল্পীদের ভূতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে নিয়োগ করা হতো। আঠারো শতকের শেষের দিকে উইলিয়াম গিলপিনের গ্রামীণ ইংল্যান্ড ভ্রমণের বর্ণনা ও তিনি নিজেই তৈরি জলরঙের চিত্র সহ বইগুলি জনপ্রিয় হয়। এটি জলরঙকে ব্যক্তিগত ভ্রমণের দিনলিপি হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলে। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ জলরঙ শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন থমাস গেইন্সবোরো, জন রবার্ট কোজেন্স, ফ্রান্সিস টাউন, মাইকেল এঞ্জেলো রুকার, উইলিয়াম পারস, থমাস হিয়ার্ন এবং জন ওয়ারউইক স্মিথ।
ঊনবিংশ শতকে মুদ্রিত বই ও গৃহস্থালীর সাজসজ্জার ক্ষেত্রে জলরঙের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। জলরঙ ছবি থেকেই ল্যান্ডস্কেপ বা ভ্রমণের চিত্রের ছাপা সংস্করণ তৈরি করা হত। উচ্চবর্গের অনেকের কাছে হাতে আঁকা জলরঙ ছবি ছিল মূল্যবান। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ জলরঙ শিল্পীদের মধ্যে পল স্যান্ডবি, থমাস গিরটিন এবং জোসেফ ম্যালোর্ড উইলিয়াম টার্নার উল্লেখযোগ্য। টার্নার জলরঙ চিত্রকলায় অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ঊনবিংশ শতকে ইংল্যান্ডে জলরঙ চিত্রকলা সমাজ গঠিত হয়। এই সমাজগুলি শিল্পীদের প্রদর্শনী ও ক্রেতা সংস্থানের ব্যবস্থা করে।
ঊনবিংশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে জলরঙের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। জন জেমস অডুবন সহ অনেকেই জলরঙে চিত্রকর্ম করেছেন। মার্কিন পেইন্টার্স ইন ওয়াটারকালার সোসাইটি (বর্তমানে আমেরিকান ওয়াটারকালার সোসাইটি) ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। উনবিংশ শতকের শেষের দিকের গুরুত্বপূর্ণ জলরঙ শিল্পীদের মধ্যে থমাস মোরান, থমাস ইকিন্স, জন লাফারজ, জন সিঙ্গার সারজেন্ট, চাইল্ড হ্যাসাম এবং উইন্সলো হোমার উল্লেখযোগ্য।
বিংশ শতকে ও এরপরের সময়েও অনেক শিল্পী জলরঙ মাধ্যমে চিত্রকর্ম করেছেন। উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন ওয়াসিলি কান্ডিনস্কি, এমিল নোল্ডে, পল ক্লে, ইগন শিলে, রাউল ডুফি, চার্লস বার্চফিল্ড, এডওয়ার্ড হপার, জর্জিয়া ও'কিফ, চার্লস ডেমুথ, জন মেরিন এবং অনেকেই।
জলরঙ রঙ তৈরির প্রধান উপাদানগুলি হল রঞ্জক, আরবীয় গাম (বাইন্ডার), গ্লিসারিন এবং অন্যান্য যৌগ। আধুনিক জলরঙ রঙ টিউব, প্যান ও তরল রূপে উপলব্ধ। আধুনিক রাসায়নিক উদ্ভাবনের ফলে জলরঙ রঙের বিভিন্নতা, তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।