খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী দরবার শরিফ: বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায়
খাজা ইউনুস আলী, বেশি পরিচিত খাজা এনায়েতপুরী নামে, ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক ও সুফি সাধক। ১৮৮৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলার এনায়েতপুরে (বর্তমান বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলা) তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম ছিল শাহ সুফী মৌলানা আবদুল করিম। তিনি ছিলেন নকশাবন্দ-মুজাদ্দেদি তরিকার অনুসারী এবং ভোগবিলাসী জীবনযাপনের তীব্র বিরোধী ছিলেন।
ইসলামের মর্মবাণী প্রচার এবং সমাজসেবা কাজের মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ভক্তরা তাঁকে 'সুলতানুল আউলিয়া' ও 'চিরস্থায়ী সংস্কারের জন্য আখেরী মুজাদ্দেদ' বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি কলকাতার প্রখ্যাত পীর খাজা ওয়াজেদ আলীর কাছে শিক্ষা ও গবেষণায় ১৭-১৮ বছর বয়সে যোগদান করেন। সৈয়দ ওয়াজেদ আলীর অনুমতিক্রমে ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম ও সুফীবাদ প্রচারের জন্য খেলাফত লাভ করেন। পরবর্তীতে নিজ গ্রামে ফিরে এসে খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম প্রচার এবং সুফিবাদ বিস্তারের কাজ শুরু করেন। তিনি ৮ কন্যা এবং ৫ পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন।
১৯১৫ সালে, অনুসারীদের পরামর্শক্রমে, এনায়েতপুর দরবার শরীফে তিনি ওরশ শুরু করেন। এতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনুসারীরা যোগদান শুরু করেন। ১২০০ এর বেশি পীর ও আউলিয়া তাঁর দরবার শরিফের সাথে যুক্ত ছিলেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ফরিদপুরের আটরশি পীর, চন্দ্রপাড়া পীর, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ পীর, টাঙ্গাইলের প্যারাডাইস পাড়া, কুমিল্লার ইসলামাবাদ, জামালপুরের সাধুরপাড়া, যশোরের ঘুনী দরবার শরীফ এবং ভারতের আসামের মেহেদীবাগ গণি খলিফার দরবার শরীফ উল্লেখযোগ্য।
১৯১৬ সালে, খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (রহ.) রাসূলে করিম (দ.)’র নির্দেশে ওরশ মাহফিল চালু করেন। প্রায় ১০৯ বছর ধরে এই ওরশ মাহফিল ব্যাপক ভক্তি-ভালোবাসার সাথে পালিত হয়ে আসছে।
১৩৫৪ বঙ্গাব্দে (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) তিনি ‘খাজা দাতব্য চিকিৎসালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের এই প্রতিষ্ঠানটি দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে ব্যাপক সাড়া ফেলে। শিক্ষার প্রতি তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। তিনি তিন ধাপে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেন এবং তার মুরিদদের কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দি এবং মুজাদ্দিদিয়া তরিকার শিক্ষা দিতেন। তিনি ‘শরিয়তের আলো’ এবং ‘গঞ্জে আশরার’ নামে দুটি বইও লিখেছেন।
২ মার্চ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয় এবং খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। তার জামাতা খাজা এম আমজাদ হোসেন এই প্রতিষ্ঠান দুটি প্রতিষ্ঠা করেন।
খাজা ইউনুস আলী দরবার শরিফ আধ্যাত্মিক চর্চা এবং সমাজসেবায় অবদানের জন্য আজও স্মরণীয়। এখানে বার্ষিক ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়, যা ব্যাপক জনসমাগমের আকর্ষণ। এ দরবার শরিফ ইসলামী আদর্শ ও সুফিবাদের ধারক হিসেবে আজও উজ্জ্বলভাবে জাগ্রত।