কমিউনিস্ট পার্টি: একটি বিশ্লেষণ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টির (Communist Party) অস্তিত্ব রয়েছে। এটি মূলত কমিউনিজম আদর্শের উপর ভিত্তি করে গঠিত একটি রাজনৈতিক দল। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং তাদের মূল ভিত্তি হল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী সংগঠক ও পরিচালক হিসেবে পরিচিত। শ্রমিক আন্দোলন তখনই সফল হয় যখন তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়, এবং কমিউনিস্ট পার্টি এই সংযোগ স্থাপন করে। ১৮৪৮ সালে মার্কস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশিত হলে কমিউনিস্ট পার্টি শব্দটির ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে, ভ্লাদিমির লেনিন কমিউনিস্ট পার্টি কে 'প্রলেতারিয়েতের অগ্রগামী পার্টি' (vanguard party) হিসাবে উল্লেখ করেন এবং মার্কসবাদকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্রের নীতি অনুসরণ করে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি হল বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দল। ২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, তাদের সদস্য সংখ্যা ৭৮ মিলিয়ন ছিল, যা দেশের জনসংখ্যার ৫.৬%। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, রোমানিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি অবৈধ।
কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন এবং শ্রেণিহীন সমাজে উত্তরণ। এটি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এবং বাস্তব কমিউনিজমে উত্তরণের পূর্বে প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্র বজায় রাখে। পার্টি সর্বদা সতর্ক থাকে যেন পুঁজিবাদী, সুবিধাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব পার্টি ও রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারে।
বাংলাদেশে একাধিক কমিউনিস্ট দল রয়েছে, যাদের রাষ্ট্রচরিত্র, বিপ্লবের স্তর, রণনীতি ও কৌশল ভিন্ন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দল হল: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বিভিন্ন মাওবাদী দল এবং অন্যান্য বামপন্থী দল। এই দলগুলি বিভিন্ন সময়ে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছে এবং রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি জোটেও কিছু কমিউনিস্ট-ঝুঁকির দল রয়েছে, যদিও তাদের অনেকের সাংগঠনিক অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মার্কসীয় কমিউনিস্ট মতবাদ ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল। এটি নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকারী সংগঠন। ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবরে তাশখন্দে প্রথম গঠিত হয়, পরে ১৯২৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর কানপুরে পুনর্গঠিত হয়।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে নিষিদ্ধ হলেও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ১৯৩৯ সালে বোম্বাইয়ে যুদ্ধবিরোধী ধর্মঘট, ১৯৪০-এর দশকে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানে পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়, ১৯৪৮ সালে কলকাতায় পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গঠন এবং ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটি গঠিত হয়।
১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কমিউনিস্ট বন্দিদের উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ, সাঁওতাল ও নাচোল বিদ্রোহ, ১৯৫৪ সালে নিষিদ্ধকরণ এবং পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছত্রছায়ায় কার্যক্রম। আইয়ুব খানের শাসনামলে নির্যাতন ও কারাদন্ড। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৭১ সালের পর ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’ (সিপিবি) নামে পরিচিত হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর পার্টির ওপর নিপীড়ন, ১৯৭৭ সালে নিষিদ্ধকরণ, ১৯৭৮ সালে প্রত্যাহার। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভেঙে পড়ার উপক্রম, এবং নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন।
কমিউনিস্ট পার্টি বর্তমানে ধর্মীয় মৌলবাদ ও দুই জোটের বাইরে বিকল্প শক্তি গঠনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারা সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।