ঐক্য: বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়
১৯৮৩ সালের ১৩ এপ্রিল, ঢাকা। দেশের ১২টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা এক যৌথ সভায় এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন - শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) গঠন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের অধীনে, যখন ট্রেড ইউনিয়নের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল, তখন এই ঐক্যবদ্ধ সংগঠন বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ধারা পাল্টে দেয়।
স্কপের উত্থান আকস্মিক নয়। ১৯৮২ সালের মার্চে সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে ৫টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে একত্রিত হন। পরবর্তীতে, ১১টি ফেডারেশন ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের একীভূত প্রচেষ্টায় স্কপ গঠিত হয়। তারা পাঁচ দফা দাবিনামা নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে যান, এবং দাবি পূরণ না হলে ধর্মঘটের হুমকি দেন।
স্কপের আন্দোলন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের সমর্থন লাভ করে। ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন, জাতীয় শ্রমিক লীগও স্কপে যোগ দেয়। স্কপের আহ্বানে দেশব্যাপী ধর্মঘট সাড়া ফেলে। প্রথমে সরকার স্কপকে অগ্রাহ্য ও অবৈধ ঘোষণা করলেও, সফল ধর্মঘটের পরে সরকারকে স্কপকে স্বীকৃতি দিতে হয়। আতাউর রহমান খান, গোলাম মোস্তফা, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ নেতাদের সাথে আলোচনার পর, ১৯৮৪ সালের ২১ মে সরকার স্কপের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার পুনঃস্থাপন, ইউনিয়ন নেতাদের চাকুরির নিরাপত্তা, মজুরি বৃদ্ধি, গ্রাচুইটি বৃদ্ধি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্কপ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৯৮৪-৮৬ সালে কাজী জাফর আহমদ, সিরাজুল হোসেন খান, রুহুল আমিন ভুঁইয়া, শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর প্রমুখ নেতারা বিভিন্ন কারণে স্কপ থেকে বিচ্ছিন্ন হন। ১৯৮৬ সালে স্কপে ভাঙন ধরে, কিন্তু পরে পুনর্গঠিত হয়। ১৯৯১-৯৫ সালে স্কপ আবারও আন্দোলন করে এবং সরকারের সাথে চুক্তি করে। ১৯৯৭ সালে আবারো ধর্মঘট হয়, এবং ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আবারো ধর্মঘট হয় ১৯৯৯ সালে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির ফলে ন্যূনতম জাতীয় মজুরি নির্ধারণ, মজুরি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, শ্রমিক আইনের আধুনিকায়ন, চাকুরিচ্যুত শ্রমিকদের পুনঃবহাল ইত্যাদি সাফল্য অর্জিত হয়। বর্তমানে স্কপ দেশের ১৬ টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রের মাধ্যমে ৯০% শ্রমিক-কর্মচারীর প্রতিনিধিত্ব করে। স্কপ বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।