১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক শাসক। এই সময়ের ঘটনা নিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু দিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কাহিনী।
প্রতিবেদনে বর্ণিত হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর, যুদ্ধ শুরুর একদিন আগে, ইয়াহিয়া খান জরুরি বার্তা পেয়েছিলেন যশোর দখলের বিষয়ে। এই ঘটনা তাকে অবিলম্বে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ এবং চিফ অব স্টাফ গুল হাসানকে তলব করতে বাধ্য করে। তিনি তার সমস্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে সকালে এক জরুরী বৈঠক করেন। বৈঠকে সেনাবাহিনীর প্রধান কমান্ডাররা প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। পাকিস্তানের এক ইঞ্চি মাটি আক্রমণের মানে পুরোদস্তুর যুদ্ধ বলে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও, যুদ্ধের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় তারা ছিলেন না বলে বর্ণিত হয়েছে।
আর্শাদ সামি খান, ইয়াহিয়া খানের এডিসি, তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াহিয়া খানের মনে কোথাও একটা ধারণা ছিল, যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থায় তিনি নেই। ৩ ডিসেম্বর, পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ভারতের বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই হামলার পরের দিন ব্রিগেডিয়ার গুল মাওয়াজ ইয়াহিয়া খানকে মদ্যপ অবস্থায় দেখতে পান। হাসান আব্বাসের বইয়ে উল্লেখ আছে যে, ইয়াহিয়া খান নূরজাহানের সঙ্গে জাপান থেকে ফোনে কথা বলেছিলেন এবং তাকে গান শোনাতে বলেছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানে পরাজয়ের খবর আসতে থাকলে গভর্নর আব্দুল মালিক যুদ্ধবিরতির জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে বারবার বার্তা পাঠান। ইয়াহিয়া খান হতাহতের সংখ্যা কমাতে পরামর্শ দেন, কিন্তু মালিক জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠান। ইয়াহিয়া খান এর অনুমতি ছাড়াই জেনারেল ফরমান আলী জাতিসংঘে বার্তা পাঠিয়ে দেন, যার জন্য ইয়াহিয়া খান তা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
ইয়াহিয়া খান প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাফল্যে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু চীন সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ইরানও অস্ত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে সাহায্য চান। নিক্সন সপ্তম নৌবহর পাঠানোর কথা বললেও তা ঢাকা পতনের পরও পৌঁছায়নি।
পুরো যুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তিনটি অংশের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খান 'সাময়িক ব্যর্থতা' হিসেবে একে উপস্থাপন করেন। আর্শাদ সামি খান মনে করেন, ৩ ডিসেম্বর রাস্তায় শকুনের দেখা যুদ্ধের ব্যর্থতার ইঙ্গিত ছিল।
ইয়াহিয়া খানের জীবনের এই বিবরণ থেকে তার নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু দিকও উঠে এসেছে, যা তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তোলে।