আইন: একটি বিস্তারিত আলোচনা
মানুষের সুষ্ঠু, স্বাধীন ও সুশৃংখল জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুনের সমষ্টিই হলো আইন। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Law’ যা ‘Lag’ থেকে উদ্ভূত। ‘Lag’ এর অর্থ স্থির, অপরিবর্তনীয় ও সর্বত্র সমানভাবে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন হল সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য বিধান, যা সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়। আইন হলো সামাজিক রীতিনীতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা। এটি নিয়মের এক পদ্ধতি যা নাগরিক বাধ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের ভিত্তি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। আইন বলতে সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে বোঝায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
হুগো গ্রোশিয়াস (১০ এপ্রিল ১৫৮৩ - ২৮ আগস্ট ১৬৪৫), ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্রের একজন আইনজ্ঞ, প্রাকৃতিক আইনের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল লিখেছিলেন, “আইনের শাসন যেকোন ব্যক্তি শাসনের চেয়ে ভাল।” শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আইনের অসংখ্য সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
আইনের ধারণা:
আইনের দর্শন আইনশাস্ত্র নামে পরিচিত। আদর্শিক আইনশাস্ত্র প্রশ্ন করে “আইন কী হওয়া উচিত?”। বিশ্লেষণমূলক আইনশাস্ত্র প্রশ্ন করে “আইন কী?”। একটি সংজ্ঞায় বলা হয়, “আইন হলো নিয়ম ও নির্দেশিকার একটি ব্যবস্থা যা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়।” এইচ.এল.এ. হার্টের মতে আইন হলো “নিয়মের ব্যবস্থা”; জন অস্টিনের মতে, “সার্বভৌম ক্ষমতার আদেশ, যা অনুমোদনের হুমকির মাধ্যমে সমর্থিত”; রোনাল্ড ডোয়ার্কিনের মতে, আইন ন্যায়বিচার অর্জনের জন্য একটি “ব্যাখ্যামূলক ধারণা”।
বিভিন্ন আইন ও তাদের প্রাসঙ্গিকতা:
• কারখানা আইন ১৯৬৫: কারখানায় শ্রমিক নিয়োগ, মজুরি, কাজের পরিবেশ, ছুটি, শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ক।
• চুক্তি আইন ১৮৭২: চুক্তি সংক্রান্ত সাধারণ বিধি, বিভিন্ন প্রকার চুক্তির পার্থক্য।
• নির্বাচনী আইন: সুষ্ঠু নির্বাচন, প্রার্থী ও ভোটার আচরণ, লঙ্ঘনের শাস্তি।
• কোম্পানি আইন: কোম্পানি গঠন, নিবন্ধন, ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষা।
• সংবিধানিক আইন: সংবিধানভিত্তিক আইন, সুপ্রীম কোর্টের রায়, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন।
• শিশু আইন: শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা, শিশুশ্রম নিষেধ।
• শ্রম আইন: শ্রমিক নিয়োগ, মজুরি, কাজের পরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি।
• পরিবেশ আইন: পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বন সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী সুরক্ষা।
• ভোক্তা আইন: ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণ, ন্যায্য মূল্যে ভাল পণ্য ক্রয়ের অধিকার।
• হিন্দু আইন: হিন্দুদের বিবাহ, উত্তরাধিকার, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ।
• নিবর্তনমূলক আটক আইন: বিনা অভিযোগে ও বিনা বিচারে আটক রাখার বিধান।
• মৎস্য আইন: মৎস্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা।
• বিশ্ববিদ্যালয় আইন: বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা, শিক্ষাকার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ।
আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া:
সংসদের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন হয়। বিল উত্থাপন, আলোচনা, ভোটগ্রহণ ও রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর আইন কার্যকর হয়। জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন।
আইন কমিশন:
আইন পুনর্নিরীক্ষণ, সংস্কার ও সুপারিশের জন্য গঠিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।
keyInformationList
আইন হলো মানুষের সুষ্ঠু জীবনের জন্য নিয়ম-কানুন।
রাষ্ট্র সার্বভৌম শক্তি দিয়ে আইন প্রয়োগ করে।
আইনের দর্শন আইনশাস্ত্র নামে পরিচিত।
বিভিন্ন আইন বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে।
সংসদ ও রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন করে।
আইন কমিশন আইন সংস্কারের সুপারিশ করে।