অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: সত্যের সন্ধানে অবিচল পদক্ষেপ
সাংবাদিকতার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এটি এমন এক ধরণের সাংবাদিকতা যেখানে সাংবাদিকরা গভীর তদন্তের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়, ব্যক্তি, ঘটনা বা প্রতিষ্ঠানের লুকানো সত্য উন্মোচন করে থাকেন। এই তদন্ত কাজে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর সময় ব্যয় হতে পারে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা মারাত্মক অপরাধ, রাজনৈতিক দুর্নীতি, কর্পোরেট অনিয়ম, সামাজিক অন্যায় ইত্যাদি বিষয়ের গভীরে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সংজ্ঞা:
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভ ওয়েনবার্গ এর সংজ্ঞা হলো: 'নিজস্ব উদ্যোগ ও কাজের ফলাফলের প্রতিবেদন, যা পাঠক, দর্শক ও শ্রোতার গুরুত্বের বিষয়'। ব্রিটিশ গণমাধ্যম তত্ত্ববিদ হ্যুগো দি বুর্গ এর মতে, 'অনুসন্ধানী সাংবাদিক হল ঐ নারী বা পুরুষ যার পেশা হল সত্য খুঁজে বের করা এবং এর বিচ্যুতি খুঁজে বের করে তা যেই মাধ্যমে সম্ভব হয় তাতে প্রকাশ করা'। অনেকেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে 'ওয়াচডগ রিপোর্টিং' বা 'অ্যাকাউন্টিবিলিটি রিপোর্টিং' বলে উল্লেখ করেন।
প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি:
প্রথাগতভাবে সংবাদপত্র, ওয়্যার সার্ভিস এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বেশি সক্রিয় ছিল। বর্তমানে বহু লাভজনক ও অলাভজনক সংগঠন এই কাজে জড়িত। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ProPublica, International Consortium of Investigative Journalists (ICIJ) অন্যতম। ICIJ আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যাপক অনুসন্ধান করে অপরাধ, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার প্রকাশ করে। পানামা পেপার্স এবং প্যারাডাইস পেপার্স এর মতো বিখ্যাত তদন্ত ICIJ এর মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা:
বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানি মামলা এবং সরকারের চাপ এই কাজের প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। তবুও, অনেক সাংবাদিক দুর্নীতি, অনিয়ম এবং মানবাধিকার উল্লঙ্ঘন সম্পর্কিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকেন। প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (PIB) এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা প্রদান করে থাকে।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি:
আবেদ খান (দৈনিক ইত্তেফাক), মতিউর রহমান চৌধুরী (মানবজমিন), মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, গোলাম মোর্তজা, দীপু সরোয়ার (একুশে টিভি) ইত্যাদি সাংবাদিক বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ:
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটি পেশা। তবে এর মাধ্যমে সমাজে জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব। সরকার এবং জনগণের পক্ষে এই ধরণের সাংবাদিকতার প্রতি সমর্থন প্রয়োজন।