আঠারো শতকে বাংলায় মারাঠা হামলা জনজীবনে অভিশাপের ন্যায় ছিল। মুগল-মারাঠা দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি ছিল এই হামলা। মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দক্ষিণাত্য বিজয় অভিযান মারাঠাদের আবাসস্থলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মারাঠাদের ‘বর্গী’ বাহিনী বাংলায় ব্যাপক লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পেশোয়া বাজিরাও প্রথম (১৭৪০-১৭৬১) এর শাসনামলে ভারতবর্ষ জুড়ে তাদের হামলা বৃদ্ধি পায়। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলায় বারবার মারাঠা আক্রমণ হয়, ১৭৫১ সালে বাংলার নওয়াব উড়িষ্যা মারাঠাদের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
১৭৪২ সালের এপ্রিলে মারাঠা বাহিনী বর্ধমান আক্রমণ করে। নওয়াব আলীবর্দী খান প্রতিরোধ করেন, কিন্তু মীর হাবিবের বিশ্বাসঘাতকতায় মারাঠারা মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত লুণ্ঠন চালায়। মীর হাবিব ভাস্কর পন্ডিতকে প্ররোচিত করে মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠন করায়। জগৎ শেঠ পরিবারের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা আদায় করে। আলীবর্দী মুর্শিদাবাদ রক্ষা করেন, কিন্তু মারাঠারা কাটোয়া দখল করে। হুগলি, রাজমহল, মেদিনীপুর, যশোর পর্যন্ত গঙ্গার পশ্চিমাঞ্চল মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। মারাঠাদের অত্যাচারে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বহু লোক গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে যায়।
১৭৪২ সালের সেপ্টেম্বরে আলীবর্দী কাটোয়ায় মারাঠাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে, ভাস্কর পন্ডিত মেদিনীপুরে পালিয়ে যায়। আলীবর্দী কটক পুনরুদ্ধার করেন। রাজা শাহু বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার চৌথ মারাঠাদের কাছে ছেড়ে দেন। রঘুজী ভোঁসলে কর সংগ্রহের অধিকার পান। পেশোয়া বালাজি বাজিরাও রঘুজীকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করেন। ১৭৪৩ সালের মার্চে রঘুজী ভাস্কর পন্ডিতকে নিয়ে কাটোয়ায় ফিরে আসেন।
পেশোয়া ও আলীবর্দীর মধ্যে সমঝোতা হয়। আলীবর্দী রাজা শাহুকে বাংলার চৌথ প্রদান করবেন এবং পেশোয়াকে ২২ লক্ষ টাকা দেবেন। রঘুজী কাটোয়া থেকে পালিয়ে যায়। ১৭৪৪ সালের মার্চে ভাস্কর পন্ডিত আবার বাংলা আক্রমণ করে। আলীবর্দী ভাস্কর পন্ডিত ও তার সঙ্গীদের মানকাড়ায় হত্যা করেন। এরপর বিহার ও উড়িষ্যায় কিছুদিন শান্তি ফিরে আসে। ১৭৪৬ সালে আলীবর্দী উড়িষ্যা পুনর্দখলের চেষ্টা করেন, কিন্তু মীরজাফর পরাজিত হয়। জানোজী ভোঁসলে মীর হাবিবের সাথে মিলিত হয়। ১৭৪৭ সালে আলীবর্দী জানোজীকে পরাজিত করেন। ১৭৪৮ সালে মারাঠারা উড়িষ্যা ও মেদিনীপুর নিয়ন্ত্রণ করে। ১৭৪৯ সালে আলীবর্দী আবার উড়িষ্যা পুনর্দখল করেন, কিন্তু মীর হাবিব আবার বাংলায় আক্রমণ করে।
১৭৫০ সালে মারাঠারা আবার বাংলা আক্রমণ করে। মীর হাবিব মুর্শিদাবাদের কাছে এসে পৌঁছায়। আলীবর্দী মেদিনীপুর থেকে পশ্চাদপসরণ করেন। মীর হাবিব আলীবর্দীর সাথে শান্তিচুক্তি করে। মীর হাবিব উড়িষ্যার নায়েব নাজিম হন। ১৭৫২ সালে মীর হাবিব মারা যায়, ফলে উড়িষ্যা আবার মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঘন ঘন মারাঠা হামলায় বাংলার অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়, জনগণ ভয়াবহ দুর্ভোগ ভোগ করে। এই ঘটনা বাংলার ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।