মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা: ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সমন্বয়
বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত কমলগঞ্জ উপজেলা ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। ৪৮৫.২৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলাটি ২৪°০৮´ থেকে ২৪°২৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°৪৬´ থেকে ৯১°৫০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। উত্তরে রাজনগর উপজেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে কুলাউড়া উপজেলা ও ভারতের আসাম রাজ্য এবং পশ্চিমে শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলা এর সীমান্তবর্তী।
জনসংখ্যা ও জনগোষ্ঠী:
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, কমলগঞ্জের জনসংখ্যা প্রায় ২৫৯১৩০; এর মধ্যে পুরুষ ১২৭৭৪৬ এবং মহিলা ১৩১৩৮৪। ধর্মীয়ভাবে, জনসংখ্যার অধিকাংশ মুসলিম (১৭৪৪৮৬), এছাড়াও হিন্দু (৮১৩৩৪), খ্রিস্টান (২২৭১) এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী রয়েছেন। এই উপজেলায় মনিপুরী, খাসিয়া, ত্রিপুরা (তিপরা), হালাম প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, যা এখানকার সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
ঐতিহাসিক ঘটনা:
কমলগঞ্জের ইতিহাস বিভিন্ন বিদ্রোহ ও আন্দোলনের সাক্ষী। বাংলা ১৩০৭ সালে ভানুবিল এলাকায় পঞ্চানন সিংহ, কাসেম আলী, বৈকুণ্ঠ শর্ম্মা এবং থেম্বা সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে প্রজা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। মোগল ও আফগানদের মধ্যে কমলগঞ্জের পতনঊষার এলাকায় এক লড়াইয়ে আফগান দলপতি খাজা উসমান নিহত হন, যার নামানুসারে এই এলাকা খাজা ওসমানগড় নামে পরিচিত। ১৯৬৮-৬৯ সালের করাইয়ার হাওর কৃষক-আন্দোলনও এই অঞ্চলের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কমলগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শমসেরনগর এলাকায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং ২৯ মার্চ ইপিআর জওয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত প্রতিরোধে বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান কমলগঞ্জের সীমান্ত এলাকার আমবাসা গ্রামে শহীদ হন। উপজেলায় শমসেরনগর বিমান ঘাঁটিতে ১টি বধ্যভূমি ও দেওড়াছড়া চা বাগান ২৫ নং সেকশনে ১টি গণকবর রয়েছে।
অর্থনীতি:
কমলগঞ্জের অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। কৃষিজমি ৪৩.১৭% গ্রাম ও ৪৭.৪২% শহরে। প্রধান কৃষি ফসলের মধ্যে রয়েছে রোপা আমন, রোপা আউশ, গম, আখ, চা, সুপারি, পান, সরিষা, আলু, শাকসবজি। চা শিল্প এখানকার অর্থনীতির এক বিশাল চালিকা শক্তি। এছাড়াও, মনিপুরী তাঁতবস্ত্রের কারখানা উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি:
শিক্ষার হার ৪৮.৬%। কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৯৫), শমসেরনগর এএটিএম উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২৯) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সংস্কৃতির দিক থেকে, মনিপুরী ললিত কলা একাডেমী উল্লেখযোগ্য।
দর্শনীয় স্থান:
কমলগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ফুলবাড়ির ভেষজ বাগান আরোগ্যকুঞ্জ, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ১২৫০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, পরীকুন্ড, মনু ব্যারেজ, হাকালুকি হাওর প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান এই উপজেলার সৌন্দর্যকে আরও বর্ণিল করে তুলেছে।
যোগাযোগ:
কমলগঞ্জে পাকারাস্তা ১৫০ কিমি, রেলপথ ১৬ কিমি এবং ২টি রেলস্টেশন আছে। ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে সহজে এই উপজেলায় যাতায়াত করা যায়।
উপসংহার:
ঐতিহাসিক ঘটনা, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যের সমন্বয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা একটি বিশেষ অঞ্চল। এই উপজেলা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য আপনার প্রশ্ন স্বাগতম।