পান্ডুয়া: ঐতিহাসিক গৌরবের স্মৃতিচিহ্ন
পান্ডুয়া, এক নাম যা ইতিহাসের গর্ভে লুকিয়ে আছে অজস্র গৌরবগাথা। একসময়ের সমৃদ্ধ রাজ্য, পরবর্তীকালে সুলতানি আমলের গুরুত্বপূর্ণ শহর, আজ পান্ডুয়া ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীন কীর্তির স্মৃতি বহন করে। বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় অবস্থিত এই শহরটি গৌড় থেকে প্রায় ৩২.১৮ কি.মি. এবং বর্তমান মালদহ শহর থেকে ১৯.৩১ কি.মি. দূরে অবস্থিত।
প্রাচীনকালে পান্ডুয়া লাউড় রাজ্যের অধীন একটি খণ্ড রাজ্য ছিল বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে উল্লেখ আছে। রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজত্বকালে (দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ) এর প্রতিষ্ঠা হয় বলে ধারণা করা হয়। তিনি বঙ্গের ব্রাহ্মণদের আশ্রয় দিয়ে জগন্নাথপুর অঞ্চলে তাদের স্থাপনা গড়ে দেন এবং জগন্নাথ মিশ্র নামে এক জৈনক ব্রাহ্মণকে দিয়ে বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করান। এই ঘটনার ফলে পরবর্তীকালে পান্ডুয়া রাজ্য জগন্নাথপুর রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে পান্ডুয়া নগর 'পেরুয়া' নামে পরিচিত।
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এই শহরটিকে টাকশাল এবং রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। 'পান্ডুইয়া' বা 'পান্ডুরিয়া' শব্দ থেকে এর নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। কানিংহামের মতে, 'পান্ডুবিস' (জলজ পাখি) হতে এর নামকরণ হয়েছে, কারণ একসময় এখানে প্রচুর জলজ পাখি দেখা যেত। ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ শহরটির নাম 'ফিরুজাবাদ' রাখেন। পনেরো শতকের চৈনিক বিবরণী অনুযায়ী, পান্ডুয়ার দেওয়াল, শহরতলি এবং বাজারগুলি ছিল অত্যন্ত সুন্দর এবং ব্যবসায়িকভাবে সমৃদ্ধ। টাকশাল শহর হিসেবে এর মর্যাদা শেরশাহের আমল (১৫৪০-৪৫ খ্রি.) পর্যন্ত ছিল। শেরশাহের রৌপ্য মুদ্রা এখান থেকেই জারি করা হতো।
মহানন্দা নদীর গতিপথের পরিবর্তন এবং ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তরের ফলে পান্ডুয়ার পতন ঘটে। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে বুকানন হ্যামিলটন এখানে কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলেন যার অস্তিত্ব আজ নেই। তবে আদিনা মসজিদ, পীর-দরবেশদের সমাধিসৌধ, একলাখী সমাধিসৌধ, দনুজদিঘি, সতাশগড় দিঘি ইত্যাদি পুরাকীর্তি আজও পান্ডুয়ার ঐতিহাসিক গৌরব বহন করে।