ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ: একজন কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী
ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ (২৬ এপ্রিল ১৮৮৪ - ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭) ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সেতার ও সুরবাহার বাদক। তিনি মাইহার ও রামপুর রাজ্যের রাজসঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। তার যন্ত্র ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব, ১৯৭৬ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।
আয়াত আলী ১৮৮৪ সালের ২৬ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সবদর হোসেন খাঁ (সদু খাঁ) নিজেও ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ। তার দুই বড় ভাই, ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, উপমহাদেশের খ্যাতনামা সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
দশ বছর বয়সে তিনি তার বড় ভাই ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর কাছে সঙ্গীতের প্রাথমিক তালিম গ্রহণ করেন। সাত বছর ধরে সরগম ও রাগ-রাগিণীর তালিম গ্রহণের পর তিনি মাইহারে তার অপর বড় ভাই আলাউদ্দিন খাঁর কাছে চলে যান সেতার ও সুরবাহারের তালিমের জন্য। পরে আলাউদ্দিন খাঁ তাকে রামপুরে তার গুরু ওয়াজির খাঁর কাছে পাঠান, যেখানে তিনি ১৩ বছর সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন ছিলেন।
শিক্ষা সমাপ্তির পর আয়াত আলী মাইহার রাজ্যের সভাবাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, তার ভাই আলাউদ্দিন খাঁর পাশেই। একসাথে তারা ঐকতান বাদকদল গঠন করেন। পরবর্তীতে রামপুরের রাজদরবারেও তিনি সভাবাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৫ সালের মে মাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধানের পদে যোগদান করেন; কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কিছুদিন পরই তিনি চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন এবং বাকি জীবন সঙ্গীত সাধনায় কাটান।
আয়াত আলী উমর-উন-নেসা খানমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন কন্যা ও তিন পুত্র ছিল। তার তিন কন্যার নাম ছিল আম্বিয়া, কোহিনূর ও রাজিয়া এবং তিন পুত্রের মধ্যে আবেদ হোসেন খান ও বাহাদুর হোসেন খান ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী এবং মোবারক হোসেন খান ছিলেন সঙ্গীত গবেষক ও লেখক।
তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘আলম ব্রাদার্স’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করেন এবং গবেষণার মাধ্যমে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্রও উদ্ভাবন করেন। ‘মনোহরা’ ও ‘মন্দ্রনাদ’ বাদ্যযন্ত্র দুটি তার সৃষ্টি। বিশুদ্ধ রাগসঙ্গীতের চর্চা, সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য তিনি ১৯৪৮ সালে কুমিল্লায় এবং ১৯৫৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আলাউদ্দিন মিউজিক কলেজ নামে দুটি সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯৫১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান রেডিওতে নিয়মিত সুরবাহার পরিবেশন করেন।
ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ঐতিহ্যবাহী ধারা রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মকে এর প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে অপূর্ব অবদান রেখে গেছেন। ১৯৬৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি ইহলীলা সমাপ্ত করেন।