বাংলা সংগীতের ইতিহাসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৬ জুন ১৯২০ - ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯) এক অমর নাম। একাধারে গায়ক, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে তিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। হিন্দি সঙ্গীত জগতে তিনি ‘হেমন্ত কুমার’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। বাংলা, হিন্দি ছাড়াও তিনি মারাঠি, গুজরাটি, ওড়িয়া, অসমীয়া, তামিল, পাঞ্জাবি, ভোজপুরি, কঙ্কণি, সংস্কৃত ও উর্দু ভাষায় গান গেয়েছেন। তিনি রবীন্দ্র সংগীতের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন এবং ‘ঈশ্বরের কণ্ঠ’ নামে খ্যাত ছিলেন। দু'বার জাতীয় পুরষ্কারসহ অসংখ্য দেশী-বিদেশী পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
তার জন্ম বারাণসীতে মাতামহের বাড়িতে। পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। কলকাতায় বেড়ে ওঠা হেমন্ত প্রথমে নাসিরুদ্দিন স্কুল এবং পরে মিত্র ইন্সটিটিউশনে পড়াশোনা করেন। সেখানে তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায় (যিনি পরবর্তীতে একজন বিখ্যাত কবি হয়ে ওঠেন) ও সন্তোষকুমার ঘোষ (বিশিষ্ট লেখক) এর সাথে বন্ধুত্ব করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েও তিনি সঙ্গীতের প্রতি আসক্তির কারণে পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে সঙ্গীত জগতে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৩৫ সালে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে আকাশবাণীতে প্রথম গান রেকর্ডিং করেন। ১৯৩৭ সালে কলাম্বিয়া লেবেলে তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম হিন্দি গান। ১৯৪১ সালে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে প্রথম চলচ্চিত্রের গান গান। ১৯৪৪ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
১৯৪৫ সালে বেলা মুখোপাধ্যায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান ছিল, পুত্র জয়ন্ত ও কন্যা রাণু।
১৯৪০ এর দশকে হেমন্ত ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ)-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং সলিল চৌধুরীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৫১ সালে মুম্বাই চলে যান এবং ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে ‘নাগিন’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৫০ এর দশকের শেষভাগে তিনি নিজের ব্যানারে হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশন্স নামে চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন। ‘নীল আকাশের নিচে’ (১৯৫৯) ছিল তাদের প্রথম প্রযোজনা। পরবর্তীতে এই প্রযোজনা সংস্থার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘গীতাঞ্জলি প্রোডাকশন্স’ হয়।
১৯৬০ এর দশকে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কয়েকটি গীতিনাট্যর গানে কণ্ঠ দেন। তিনি বহুবার বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে হলিউডের এক ছবিতে প্রথম ভারতীয় হিসেবে নেপথ্য গায়কের কাজ করেন।
১৯৮০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং তার কণ্ঠে সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৮৭ সালে পদ্মভূষণ পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে ফিরে আরেকটি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।