হলুদ সাংবাদিকতা: এক অসৎ প্রতিযোগিতার ইতিহাস
হলুদ সাংবাদিকতা, এই শব্দটির সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু কী হলুদ সাংবাদিকতা এবং এর উৎপত্তি কীভাবে? হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটি সাংবাদিকতার এক নেতিবাচক দিককে তুলে ধরে। সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশার জন্য এটি এক ধরণের অপবাদ।
সংজ্ঞা:
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা, ভিত্তিহীন বা তুচ্ছ বিষয়কে চটকদার শিরোনামে উপস্থাপনের মাধ্যমে জনসাধারণকে তা পড়তে বা দেখতে বাধ্য করাই হলুদ সাংবাদিকতা। সত্য গোপন, মিথ্যাকে সত্যে প্রতিস্থাপন ও সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ করাই এর মূল নীতি।
উদ্দেশ্য:
হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য পাঠক, দর্শক ও শ্রোতার সংখ্যা বৃদ্ধি। নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে মিথ্যা প্রচারণা ও প্রতারণামূলক শিরোনামে গ্রাহককে আকৃষ্ট করা হয়।
ইতিহাস:
হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস জোসেফ পুলিৎজার এবং উইলিয়াম র্যান্ডলফ হার্স্টের সাথে জড়িত। উভয়ের অবদান সাংবাদিকতায় বিরাট হলেও, ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বা হলুদ সাংবাদিকতার সূত্রপাত তাদের হাত ধরেই। ১৮৮২ সালে হার্স্ট জোসেফ পুলিৎজারের ভাইয়ের কাছ থেকে ‘দ্য জার্নাল’ নামে একটি পত্রিকা কিনে নেন। পুলিৎজার এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৮৮৩ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড কিনে নেন। এরপর দুজনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
পুলিৎজার রমরমা খবর ও আকর্ষণীয় শিরোনামে পত্রিকার কাটতি বাড়াতে চেষ্টা করেন। তিনি রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট নামে একজন কার্টুনিস্টকে নিয়োগ করেন, যিনি ‘হোগানস অ্যালি’ নামে একটি কমিক স্ট্রিপ আঁকেন। এই কমিকের মূল চরিত্রটি ছিল হলুদ রঙের, যাকে ‘ইয়েলো কিড’ বলা হতো।
হার্স্ট বেশি বেতনে আউটকল্টকে নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন। পুলিৎজার জর্জ লুক্সকে নিয়োগ দিয়ে ‘ইয়েলো কিড’ কমিক চালিয়ে যান। দুটো পত্রিকাতেই ‘ইয়েলো কিড’ ছাপা হতে থাকে। এই প্রতিযোগিতার ফলে নোংরা সাংবাদিকতা বিকাশ লাভ করে।
‘ইয়েলো জার্নালিজম’ নামকরণ:
দ্য নিউইয়র্ক সানের সম্পাদক চার্লস ডেনা এই নোংরামির নামকরণ করেন ‘ইয়েলো জার্নালিজম’। ধীরে ধীরে চটকদার গালগপ্প ও মিথ্যা সংবাদ এই পত্রিকাদুটিতে ছাপা হতে থাকে।
স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের ভূমিকা:
কিউবার হাভানাতে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ ডুবিতে স্পেনকে মিথ্যা দোষারোপ করে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ দায়ী বলে মনে করা হয়। যুদ্ধের ফলে দুই দেশের অনেক মানুষ মারা যায়।
সাংবাদিকতার উপর প্রভাব:
পুলিৎজার ও হার্স্টের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তবে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র মাধ্যমে তাঁরা সাংবাদিকতার মান ক্ষুণ্ণ করেছিলেন। বস্তুনিষ্ঠতা বাদ দিয়ে বাহ্যিক চাকচিক্য ও উত্তেজনা তাদের কাছে প্রধান ছিল। এই ঘটনা আজও সাংবাদিকতা চর্চায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উপসংহার:
হলুদ সাংবাদিকতা সাংবাদিকতার জন্য একটি অশোভন দিক। এটি মিথ্যাচার ও অতিরঞ্জনের মাধ্যমে গ্রাহক আকর্ষণের চেষ্টা করে এবং গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করে।