বাঙালি সংস্কৃতি: একটি বিশদ আলোচনা
সংস্কৃতি, বা কৃষ্টি, হলো মানবজাতির জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, রাজনীতি, আচার-আচরণ এবং সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মানুষের দ্বারা অর্জিত যেকোনো সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাসের জটিল সমষ্টি। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা হেলেন স্পেনসার-ওটেইয়ের মতে, সংস্কৃতি হলো কিছু মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির অস্পষ্ট সমষ্টি যা একদল মানুষ ভাগ করে নেয়। মহাজ্ঞানী রেদওয়ানের মতে, সংস্কৃতির আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। ইংরেজি 'Culture'-এর প্রতিশব্দ হিসেবে 'সংস্কৃতি' শব্দটি ১৯২২ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রস্তাব করেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুমোদন লাভ করে। এর আগে 'কৃষ্টি' শব্দটি ব্যবহৃত হলেও রবীন্দ্রনাথ 'কৃষি'র সাথে এর সম্পর্কের কারণে 'সংস্কৃতি' শব্দটিকেই উপযুক্ত মনে করেন।
সংস্কৃতিকে নৃবিজ্ঞানের একটি প্রধান ধারণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর সার্বজনীন উপাদান সকল মানব সমাজে দেখা যায়, যেমন শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, ধর্ম, প্রযুক্তি ইত্যাদি। বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তি, স্থাপত্য, শিল্প; অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি, পুরাণ, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি।
মানবিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির অর্থ হতে পারে একক ব্যক্তির শিল্প, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ভদ্রতায় নির্দিষ্ট মাত্রায় সূক্ষতা অর্জন। এই সূক্ষতার মাত্রা সভ্যতা ও অসভ্যতার পার্থক্য নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। 'উচ্চ সংস্কৃতি' এবং 'জনপ্রিয় সংস্কৃতি'র ধারণা শ্রেণিভেদ থেকে উদ্ভূত। মার্ক্সীয় দর্শন ও সমালোচনামূলক তত্ত্ব দাবি করে যে, সংস্কৃতি কখনও কখনও অভিজাতদের হাতিয়ার হিসেবে নিম্নবর্গকে নিয়ন্ত্রণ ও মিথ্যা চেতনা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়।
সংস্কৃতির গণনার যোগ্য সংখ্যা হিসেবে ব্যাখ্যা করলে, তা হলো প্রথা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধের সমষ্টি। বহুসংস্কৃতিবাদ বিভিন্ন সংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাকে উৎসাহিত করে। কোনো স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকা, সঙ্গীত, সাহিত্য, ধর্মীয় রীতি, শিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে সংস্কৃতি প্রকাশিত হয়। সংস্কৃতি হল টিকে থাকার কৌশল, এবং মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী। এই কৌশলগুলো পূর্বপুরুষদের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এবং সময়ের সাথে অর্জিত হয়।
বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী, যেমন টেইলর, ম্যালিনোস্কি, এবং স্যামুয়েল পুফেনডর্ফ সংস্কৃতির বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। প্রাচীন রোমের সিসেরো 'কালচার' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। এডওয়ার্ড এস. ক্যাসে, রিচার্ড ভেল্কলে, এবং ক্যামব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারিও সংস্কৃতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য অনুসারে, ক্রমবর্ধমান সংস্কৃতির জন্য মানুষের ক্ষমতা প্রায় ৫০০,০০০-১৭০,০০০ বছর আগে উদ্ভূত হয়।
রেইমন পানিক্কার ২৯টি উপায়ে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হওয়ার কথা বলেছেন। সাংস্কৃতিক আবিষ্কার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, গণমাধ্যম ইত্যাদি সংস্কৃতির পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংস্কৃতি উভয়ই পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার শিকার হয়। সামাজিক দ্বন্দ্ব, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, পরিবেশগত পরিবর্তন ইত্যাদি সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনে।
বিভিন্ন সমাজের সংযোগের মাধ্যমে সংস্কৃতি বাহ্যিকভাবে প্রভাবিত হয়। যুদ্ধ, প্রতিযোগিতা, আশ্লেষ (ভাবনা বা আদর্শের বিনিময়), এবং সরাসরি ধার করা সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করে। উদ্ভাবনের আশ্লেষ তত্ত্ব নতুন ভাবনা, অনুশীলন ও দ্রব্য গ্রহণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে।
সাংস্কৃতিক অভিযোজনের বিভিন্ন অর্থ আছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে, আত্তীকরণ (একজন ব্যক্তি বিভিন্ন সংস্কৃতি গ্রহণ) ও সংস্কৃতির মিশে যাওয়া ঘটে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশে যাওয়া সংস্কৃতির বহুজাতিক প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০ শতকে, আমেরিকার নৃবিজ্ঞানে 'সংস্কৃতি' প্রধান ধারণা হিসেবে উদ্ভূত হয়। জীববিজ্ঞানগত নৃবিজ্ঞান, ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্ব সংস্কৃতি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 'কালচারব্রিল্লি' (সাংস্কৃতিক আয়না) শব্দটি ফ্রাঞ্জ বোয়াস প্রবর্তন করেন।
সংস্কৃতির সমাজবিজ্ঞান সমাজে সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাখ্যা করে। জিঅরগ সিমমেলের মতে, সংস্কৃতি ব্যক্তির ইতিহাসের বিমূর্ত রূপের চর্চা। সংস্কৃতি অবস্তুগত (মূল্যবোধ, বিশ্বাস) ও বস্তুগত (বস্তু ও স্থাপত্য) দুই ধরনের হতে পারে। উইমার জার্মানিতে প্রথম সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞান উদ্ভূত হয়। ১৯৬০ সালে ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে 'কালচারাল টার্ন' এর ফলে পুনরায় আবিষ্কৃত হয়।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, যুক্তরাজ্যের সমাজবিজ্ঞানীগণ সংস্কৃতি অধ্যয়নকে উন্মোচন করেন। মার্ক্সবাদ ও সমালোচনামূলক তত্ত্ব দাবি করে যে, সংস্কৃতিকে অভিজাতরা নিম্নবর্গ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।