রামপাল

রামপাল: পাল বংশের শেষ মহান শাসক

রামপাল (আনু. ১০৮২-১১২৪ খ্রি.) পাল বংশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজা ছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ কাব্যে রামপালের গৌরব ও কীর্তি বর্ণিত হয়েছে। বিদ্রোহী কৈবর্তদের কবল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চল পুনরুদ্ধার তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব। এই অভিযানের ফলে পাল শাসন বাংলায় নবজীবন লাভ করে।

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শূরপালের পর পাল সিংহাসনে আরোহণ করে রামপাল পাল সাম্রাজ্যকে বিহারের কিছু অংশ ও পশ্চিমবঙ্গে সীমাবদ্ধ দেখতে পান। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে কৈবর্ত নেতা দিব্য বরেন্দ্র দখল করে নিয়েছিলেন, এবং তখন থেকেই বরেন্দ্র পালদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উত্তর বিহার ছিল কর্ণাট বংশীয় মিথিলা রাজার শাসনাধীন। এই বংশের রাজা নান্যদেব (আনু. ১০৯৭-১১৫০ খ্রি.) ছিলেন রামপালের সমসাময়িক। বঙ্গের কর্তৃত্ব ছিল বর্মণ বংশের হাতে। বিক্রমপুর ছিল তাদের রাজধানী। পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ বিহারেও রামপালের কর্তৃত্ব ছিল নামমাত্র, সামন্তরাজগণ তাঁর প্রতি সামান্যই আনুগত্য প্রদর্শন করতেন।

দিব্য, রুদোক ও ভীম পরপর বরেন্দ্র শাসন করেছিলেন। ভীমের শাসনামলে রামপাল ‘জনকভূ’ (বরেন্দ্র) পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনি একে একে সামন্তদের এলাকাসমূহে গমন করেন এবং তাদেরকে প্রচুর অর্থ ও ভূমি দান করে তাদের আনুগত্য অর্জন করেন। এই ‘সামন্তচক্রের’ দখলে ছিল শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী, হস্তিযুক্ত ও পদাতিক বাহিনী। সামন্তদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে রামপাল ভীমের শক্তিশালী দুর্গ আক্রমণ করেন। মনে হয় রামপালের প্রতি সামন্তগণ শিথিল আনুগত্য জ্ঞাপন করতেন। ক্ষমতাবান এই সামন্তদের দ্বারে দ্বারে তাঁকে ঘুরতে হয়েছে। স্বীয় রাজশক্তির দুর্বলতা সম্পর্কে রামপালের ছিল সম্যক ধারণা, সুতরাং শক্তিশালী সামন্তদের সমর্থন আদায়ের পূর্বে ভীমের মতো পরাক্রান্ত শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করে তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। রামচরিত-এ উল্লেখ আছে যে, রামপাল চৌদ্দজন সামন্তের আনুগত্য অর্জনে সক্ষম হন। ভীমকে পরাভূত করে রামপাল বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার করেন। তিনি দীর্ঘদিন কৈবর্তদের শাসনাধীনে থাকা বরেন্দ্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে একটি নগর স্থাপন করে এর নাম দেন রামাবতী। মদনপালের শাসনামল পর্যন্ত এই রামাবতীই ছিল পাল সাম্রাজ্যের রাজধানী।

কৈবর্তদের কবল থেকে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার রামপালের মহিমান্বিত কীর্তি। অতঃপর তিনি আরও গৌরব অর্জনে তৎপর হন। পূর্বাঞ্চলের বর্মণরাজ রামপালকে রথ ও হাতি উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে প্রশমিত ও স্বীয় নিরাপত্তা বিধান করেন। রামপাল কামরূপ বা এর অংশবিশেষ জয় করেন এবং উড়িষ্যাতেও কিছুটা সাফল্য লাভ করেন। গহড়বাল বংশীয় রাজাদের সাথেও তাঁর সংঘর্ষ হয় এবং পশ্চিম সীমান্তের এই প্রবল শত্রুদের কবল থেকে নিজ রাজ্য রক্ষায় সক্ষম হন। রামপালের মৃত্যুর পর গহড়বালগণ পালসাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেয়।

রামচরিতম্ থেকে জানা যায় যে, বৃদ্ধবয়সে রামপাল নিজ পুত্র বা পুত্রগণের হাতে রাজকার্য অর্পণ করে দীর্ঘকাল শান্তিতে অতিবাহিত করেন। পরিণত বয়সে সিংহাসনারোহণ করে রামপাল (জ্যেষ্ঠ দুই ভ্রাতার পর তিনি সিংহাসন লাভ করেন এবং পিতা তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করেন) সুদীর্ঘ ৪২ বছর রাজত্ব করেন।

শাসক হিসেবে রামপাল সাফল্যের পরিচয় দেন। তিনি হূতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন এবং নিজে যে অবস্থায় রাজ্যকে পেয়েছিলেন তার চেয়ে অনেক সুদৃঢ় অবস্থায় রাজ্যটিকে উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যেতে সক্ষম হন। রাজ্য পুনরুদ্ধারে তিনি বিরুদ্ধভাবাপন্ন সামন্তদের সমর্থন লাভ করেন। তিনি কামরূপের ওপর পাল সাম্রাজ্যের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেন এবং উদীয়মান গহড়বালদের নিকট থেকে নিজ রাজ্যের সুরক্ষা বিধান করেন। উড়িষ্যাতেও তিনি আংশিক সাফল্য অর্জন করেন। তিনি ক্ষয়িষ্ণু পাল সাম্রাজ্যকে দ্বিতীয় জীবন দান করেন। রামপালের অবর্তমানে তাঁর উত্তরাধিকারিগণ পাল বংশের পতন রোধ করতে সক্ষম হন নি।

মূল তথ্যাবলী:

  • রামপাল ছিলেন পাল বংশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজা।
  • তিনি বিদ্রোহী কৈবর্তদের পরাজিত করে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
  • রামপালের রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্য নবজীবন লাভ করে।
  • তিনি কামরূপ ও উড়িষ্যায় আংশিক সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
  • ‘রামচরিত’ কাব্যে রামপালের কীর্তি বর্ণিত হয়েছে।