মুন্সীগঞ্জ জেলা: ঐতিহাসিক গৌরব ও বর্তমান অগ্রযাত্রা
বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হল মুন্সীগঞ্জ জেলা। প্রাচীনকালে বিক্রমপুর নামে পরিচিত এই জেলা ৯৫৪.৯৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে বিস্তৃত। উত্তরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ, দক্ষিণে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এবং পদ্মা নদী, পূর্বে মেঘনা নদী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর এবং পশ্চিমে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলায় বেষ্টিত। ২৩°২৩´ থেকে ২৩°৩৮´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°১০´ থেকে ৯০°৪৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এর অবস্থান।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে ‘স খলু শ্রী বিক্রমপুর সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধবারাত’ উল্লেখ রয়েছে। লক্ষ্মণসেনের পরাজয়ের পর তার পুত্ররাও কিছুকাল এ অঞ্চল শাসন করেছিলেন। ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে দনুজমাধব দশরথদেব বা জিয়াউদ্দীন বরনীর দনুজ রায় রাজধানী সোনারগাঁও স্থানান্তর করলে মুন্সীগঞ্জের গুরুত্ব কমে যায়। মোঘল আমলে এটি পরগনা হিসেবে পরিচিত ছিল। মোঘল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের প্রতিরোধ মুন্সীগঞ্জের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুন্সীগঞ্জ জেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২৯ মার্চ ছাত্ররা অস্ত্রাগার লুট করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গজারিয়া ও কেওয়ারে পাকবাহিনীর নৃশংসতা, নারায়ণগঞ্জ আক্রমণে মুন্সীগঞ্জের তরুণদের অংশগ্রহণ, ধলাগাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ, শ্রীনগর ও লৌহজং থানা দখল, টংগিবাড়ী থানা আক্রমণ এবং শিবরামপুরে পাকবাহিনীর গানবোট ডুবিয়ে দেওয়া ইতিহাসের পাতায় অম্লান স্মৃতি রেখে গেছে। ২৭ রমজানে মুন্সীগঞ্জ শহর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে এবং ১১ ডিসেম্বর সম্পূর্ণ মুক্ত হয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
মুন্সীগঞ্জ সমতল অঞ্চল নয়, কিছু কিছু উঁচু এলাকা থাকলেও পাহাড় নেই। বর্ষাকালে পানিবদ্ধ হয়ে পড়ে। বর্তমানে জেলার জনসংখ্যা প্রায় ১২,৯৩,৯৭২ জন। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এখানে বসবাস করে। শিক্ষার হার ৭৫%। জেলায় কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কে কে গভঃ ইন্সটিটিউশন, আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বিক্রমপুর টংগীবাড়ী সরকারি কলেজ, মুন্সীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, সরকারি শ্রীনগর কলেজ, রংমেহার উচ্চ বিদ্যালয় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
অর্থনীতি:
কৃষি মুন্সীগঞ্জের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তবে শিল্পেরও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। হিমাগার, সিমেন্ট, লবণ, কাগজ, টিস্যু, জাহাজ নির্মাণ, ম্যাচ ফ্যাক্টরী প্রভৃতি শিল্প এখানে প্রতিষ্ঠিত। মাওয়া নগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংস্কৃতি:
দুর্গাপূজা, নববর্ষ, চৈত্র সংক্রান্তি, যাত্রা, পালাগান, কবিগান, কীর্তন, বাউল গান, শ্যামসিদ্ধির মেলা, ঝুলন মেলা, রথযাত্রা, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা প্রভৃতি মুন্সীগঞ্জের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রামপালে হাজার বছরের পুরোনো বৌদ্ধ বিহারের আবিষ্কার এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে।