মাদ্রাসা: ইসলামি শিক্ষার ধারক ও বাহক
মাদ্রাসা (আরবি: مدرسة, madrasah) আরবি শব্দ ‘দারস’ (পাঠ) থেকে উদ্ভূত। মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসা পরিচিত। প্রাথমিক স্তরের মাদ্রাসাগুলোকে মক্তব, নূরানী বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা বলা হয়। এখানে কুরআন শিক্ষা ও আবৃত্তি দেওয়া হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন ধরণের মাদ্রাসা রয়েছে, যেমন: ইবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল, হাফিজিয়া, কওমি, দীনীয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি।
- *মাদ্রাসার ইতিহাস:**
ইসলামের প্রথম দিকে, মসজিদেই শিক্ষা প্রদান করা হতো। মুহাম্মদ (সা.) নিজেই সাফা পর্বতের পাদদেশে জায়েদ-বিন-আরকামের বাড়িতে শিক্ষাদান করতেন। হিজরতের পর মসজিদে নববীতে মাদ্রাসা আহলে সুফ্ফা স্থাপিত হয়। এই মাদ্রাসায় কুরআন, হাদিস, ফিকহ, প্রাথমিক চিকিৎসা, বংশতত্ত্ব, তাজবিদ ইত্যাদি পাঠদান করা হতো। এছাড়া, অশ্বারোহণ, যুদ্ধবিদ্যা, হস্তলিপি, শারীরিক শিক্ষা ইত্যাদিও শেখানো হতো। উমাইয়া খিলাফতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত মাদ্রাসার প্রথম পর্যায় বলে ধরা হয়।
১০ম শতাব্দী থেকে মকতব নামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইবনে সিনা ১১শ শতাব্দীতে মকতবের শিক্ষকদের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন, শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরে। তিনি ৬ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন, যেখানে কুরআন, হাদিস, ইসলামি দর্শন, ভাষা, সাহিত্য, ইসলামি আচার-আচরণ এবং ব্যবহারিক দক্ষতা শেখানো হবে।
- *উপমহাদেশে মাদ্রাসা:**
ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। মুলতানে সর্বপ্রথম মাদ্রাসার ভবন নির্মিত হয় (নির্মাতা: নাসির উদ্দীন কুবজা, প্রধান: মাওলানা কুতুবুদ্দীন কাশানি)। সুলতানি আমলে আরবি, নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতিক, কালাম, তাসাউফ, সাহিত্য, ফিকহ, দর্শন ইত্যাদি পাঠদান করা হতো।
বাংলাদেশে, ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে সুলতান গিয়াসুদ্দীন (১২১২ খ্রিষ্টাব্দ) ও দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হোসেন শাহ ও নুসরত শাহ গৌড়ে আরও কয়েকটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান ঢাকায়, নবাব জাফর মোরশেদ আলী খান মুর্শিদাবাদে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১১৭৮ হিজরিতে জমিদার মুন্সি সদরুদ্দীন আল মুসাভী বর্ধমান মাদ্রাসা স্থাপন করেন।
ইংরেজ শাসনামলে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা মাদ্রাসা দরসে নিজামি পাঠ্যক্রম প্রবর্তন করে। এই পাঠ্যক্রমে আরবি, ফারসি ভাষার ৯৯টি গ্রন্থ, ইসলামি আইন, ইউনানি চিকিৎসা, কুটিরশিল্প ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- *বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষা:**
বর্তমানে বাংলাদেশে তিন প্রকার মাদ্রাসা রয়েছে: প্রাচীন দরসে নিজামি, পরিবর্তিত দরসে নিজামি এবং আলিয়া নেসাব। বেসরকারি শিক্ষা বোর্ড (১৯৭৮) কওমি মাদ্রাসাগুলির কার্যক্রম সমন্বয় করে। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলিতে বাংলা, ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলিত। মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায়। দারুল উলুম দেওবন্দের আদলে স্থাপিত কওমি মাদ্রাসাগুলি স্থানীয়দের চাঁদা, সদকা ও যাকাতের উপর নির্ভরশীল।
ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য নিউ স্কীম মাদ্রাসা চালু হয়। এসব মাদ্রাসায় ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি ইসলামি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়।
মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে।