বরাক উপত্যকা: ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি ও রাজনীতি
ভারতের আসাম রাজ্যের দক্ষিণাংশে অবস্থিত বরাক উপত্যকা (দক্ষিণ আসাম নামেও পরিচিত) অঞ্চলটির ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি ও রাজনীতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও জটিল। বরাক নদীর নামানুসারে নামকরণ হওয়া এই উপত্যকাটি প্রায় ৬৯২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। শিলচর এখানকার প্রধান শহর।
ঐতিহাসিক পটভূমি:
প্রাচীনকালে বরাক উপত্যকার নাম ছিল 'বরবক্র'। ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হিসাবে শুরু করে পরবর্তীতে কছাড়ি রাজ্যের অধীনে আসে এই অঞ্চল। ১৫৬২ সালে কচ রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর, নর নারায়ণের মৃত্যুর পর স্বাধীন হয়ে ওঠে খাসপুর রাজ্য হিসাবে। ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ-ভারতে যুক্ত হয় কছাড়ি রাজ্য। ব্রিটিশরা ১৫৭টি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে শিলচরকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করে। ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের পর, করিমগঞ্জ ভারতে থাকে এবং সিলেটের বাকি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) যায়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা:
ভৌগোলিকভাবে, বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমের সমভূমি সীমান্ত ব্যতীত, বরাক উপত্যকা তিন দিকে পাহাড়ে ঘেরা। আসামের তিনটি প্রশাসনিক জেলা – কাছাড়, করিমগঞ্জ, এবং হাইলাকান্দি – নিয়ে গঠিত এই উপত্যকার জনসংখ্যা (২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী) ৩৬,২৪,৫৯৯। জনসংখ্যা গঠনে মুসলিম ৫০.১%, হিন্দু ৪৮.১%, খ্রিস্টান ১.৬% এবং অন্যান্য ০.২%। ভাষার দিক থেকে বাংলা প্রধান ভাষা, যদিও অনেকে সিলেটি ভাষাতেও কথা বলেন।
অর্থনীতি:
চা উৎপাদন বরাক উপত্যকার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। জুটও উৎপাদিত হয় এখানে। প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপস্থিতিও রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
১৯৬১ সালে, আসাম সরকার অসমীয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বরাক উপত্যকায় ব্যাপক আন্দোলন সংঘটিত হয়। এই আন্দোলনের সময় শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন প্রতিবাদকারী নিহত হয় (১৯ মে)। এই ঘটনা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে।
বন্যপ্রাণ:
এশিয়ান হাতি উপত্যকার বেশিরভাগ এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বরাক উপত্যকার একমাত্র বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হল বারাইল, যা ড. আনোয়ারউদ্দীন চৌধুরীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।
রাজনীতি:
বরাক উপত্যকায় দুটি লোকসভা আসন এবং ১৫টি বিধানসভা আসন রয়েছে। বর্তমানে বরাক উপত্যকার স্বায়ত্তশাসন বা পৃথক রাজ্যের দাবী উঠছে।
উপসংহার:
বরাক উপত্যকা এক অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধিকারী। এর ভৌগোলিক সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ একে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল করে তুলেছে। তবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এ অঞ্চল।