চিনি: একটি মিষ্টি ইতিহাস
চিনি, মানুষের জীবনে সুস্বাদের প্রতীক, একইসাথে একটি জটিল ইতিহাসের অধিকারী। শুধু মিষ্টান্নের উপাদান নয়, চিনি বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক বিশ্বে, চিনির যাত্রা এক অবিরাম গল্প।
প্রাচীনকালে, ভারতীয় উপমহাদেশে আখ থেকে চিনি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনির উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। প্রাথমিকভাবে কাঁচা আখ চিবিয়ে এর মিষ্টি আহরণ করা হতো। পরে ভারতীয়রা আখের রসকে দানাদার স্ফটিকে পরিণত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে। ৫ম শতাব্দীর দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় ‘স্ফটিক চিনি’ আবিষ্কৃত হয়, যাকে স্থানীয় ভাষায় খন্ড (खण्ड) বলা হতো, যা পরবর্তীতে ক্যান্ডি শব্দের উৎস। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই পদ্ধতি চীনে ছড়িয়ে দেন। উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে (৬০৬-৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ভারতীয় দূতরা তাং-এর সম্রাট তাইজংকে (৬২৬-৬৪৯ খ্রিস্টাব্দ) আখ চাষের পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন, যার ফলে ৭ম শতাব্দীতে চীনে প্রথম আখের বাগান স্থাপিত হয়।
চিনি ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ম্যাসেডোনিয়ার আলেকজান্ডারের অ্যাডমিরাল নিয়ারকাস ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত অভিযানের সময় চিনির সাথে পরিচিত হন। ১ম শতাব্দীতে গ্রীক চিকিত্সক পেডানিয়াস ডায়োসকোরাইডস তার চিকিৎসা গ্রন্থে চিনির উল্লেখ করেন। আরবরা চিনি সিসিলি ও স্পেনে নিয়ে যায়, পর্তুগিজরা ব্রাজিলে। ক্রুসেডাররা পবিত্র ভূমি থেকে চিনি ইউরোপে নিয়ে আসে। মধ্যযুগে চিনি একটি বিলাসী পণ্য ছিল, কিন্তু ১৫ম শতাব্দীতে মেডেইরা ও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে চাষের মাধ্যমে চিনির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ১৮ শতকের শেষভাগে প্রুশিয়ায় এবং পরে নেপোলিয়নের ফ্রান্সে চিনির আরেকটি উৎস- বীট-এর ব্যবহার শুরু হয়। এন্ড্রিয়াস সিগিসমুন্ড মার্গগ্রাফ ১৭৪৭ সালে বীটে চিনির উপস্থিতি আবিষ্কার করেন, এবং ফ্রান্স কার্ল আচার্ড এর শিল্পোৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
ঔপনিবেশিক যুগে চিনি বিশ্বের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অসংখ্য দাস ও শ্রমিককে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ ও অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। চিনি বহু জাতির জাতিগত মিশ্রণে প্রভাব ফেলে।
বিংশ শতাব্দীতে চিনির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। উচ্চমাত্রায় চিনির ব্যবহার স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং দাঁত ক্ষয়ের সাথে সম্পর্কিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছে যে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের চিনির ব্যবহার মোট শক্তির ১০% এর কম রাখা উচিত।
চিনি শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আখ চাষ এবং চিনিকলগুলিতে অনেক মানুষ কর্মসংস্থান লাভ করে। তবে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আধুনিকায়ন জরুরী।
চিনি – একটি মিষ্টি গল্প যা এখনও লেখা হচ্ছে।